চতুর্থ ধাপে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ৯টিতেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন জামানত হারিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শামসুল হকের সঙ্গে।
প্রথম আলো: ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা) আসন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই আসনে নৌকা হারেনি। এবার নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
শামসুল হক: দেখার বিষয়, ১০টার মধ্যে যে ৯টায় নৌকা হেরেছে, জয়ীরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কি না। ভোট নিরপেক্ষ হয়েছে। নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বলে কেউ ভোট কেটেও নেননি, ছিঁড়েও নেননি। ওটাই ওখানকার চিত্র। ভোট নিরপেক্ষ হওয়াতেই নৌকার প্রার্থীর বাইরে ওই নয়জন অন্য প্রতীক দিয়ে জয়লাভ করতে পেরেছেন।
প্রথম আলো: অনেকে বলছেন, যোগ্যদের মনোনয়ন না দেওয়ায় এই ফল বিপর্যয়। আপনার কী মত?
শামসুল হক: যেসব রাজনৈতিক নেতারা মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁদের এলাকা সম্পর্কে ধারণা কম। এ কারণে এলাকার জনগণের মতিগতি, প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম। মনোনয়ন প্রদানকারী নেতাদের ধারণা কম থাকায় নির্বাচনে এমন ফল হয়েছে।
প্রথম আলো: এমন ফল বিপর্যয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে?
শামসুল হক: জাতীয় নির্বাচনের সব জননেত্রী শেখ হাসিনামুখী। নেত্রীর ব্যক্তিত্ব, উন্নয়ন দেখে সারা দেশে নৌকার ভোট অনেক বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। জাতীয় পর্যায়ে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এমপি নির্বাচন থেকে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত যদি মনোনয়নগুলো নিরপেক্ষ হয়; জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাবই ফেলবে না। বরং যেকোনো নির্বাচনে জয় সুনিশ্চিত। নির্বাচনে বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কিংবা অন্য দলের দু–একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতেই পারেন। নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে, এটা তার প্রমাণ।
প্রথম আলো: আপনি বললেন সঠিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হলে জাতীয় নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তাহলে কি আমরা বলতে পারি, বোয়ালমারীতে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন যথাযথ হয়নি?
শামসুল হক: ওখানে যাঁরা মনোনয়ন দিয়েছেন; এলাকার নেতা–কর্মীরা কে কেমন কাজ করেন, তাঁদের ব্যাপারে ধারণা কম থাকতে পারে। কে কেমন জনপ্রিয়, সেটা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম থাকতেই পারে। এতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
প্রথম আলো: স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ আবদুর রহমানের দ্বন্দ্বের কারণেই তৃতীয় ও চতুর্থ সারির নেতারা নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। এই দ্বন্দ্বকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
শামসুল হক: প্রথম সারিতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মনোনীত ব্যক্তিরা এবং দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন সাবেক সাংসদের মনোনীত ব্যক্তিরা। আপনি বলছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ সারির নেতারা মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁরা কার লোক? যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা নিজেদের জনপ্রিয়তার জোরে দাঁড়িয়ে গেছেন, নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রথম আলো: বোয়ালমারীতে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এটাকে আপনি যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন?
শামসুল হক: মনোনয়ন দেওয়ায় ভুল হলে এমনটি ঘটা বিচিত্র নয়। যোগ্য ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দিতে হয়। দলীয় মনোনয়ন হলে সব দলই চায় ভালো প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে। আওয়ামী লীগ যদি চিকিৎসক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, তাহলে বিএনপি চাইবে একজন প্রকৌশলীকে মনোনয়ন দিতে। পার্টি মনোনয়ন দিলে এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে উপজেলা পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, ইউনিয়ন পর্যায়ে ঠিক সেভাবে দেখা হয় না। এ কারণে অনেকেই মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলেই ভালো হয়।
প্রথম আলো: ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী যাঁরা জিতেছিলেন, তাঁরা স্বতন্ত্র সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সনের অনুসারী। সেখানে কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে সাংসদের একটা ভোটের হিসাব আছে। কিন্তু বোয়ালমারীতে সেই হিসাব নেই। তাহলে সেখানে নৌকার এমন ভরাডুবি কেন?
শামসুল হক: ভাঙ্গার মতো হিসাব এই এলাকায় নেই। এ কারণে বোয়ালমারীতে কোনো সমস্যা হবে না। ফরিদপুর-১ চিরকালই আওয়ামী লীগের আসন। আলফাডাঙ্গায় আমাদের ৯৯ শতাংশ ভোট আছে। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। ওই আসনে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
প্রথম আলো: বোয়ালমারীতে নৌকার ভরাডুবি থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেওয়ার কিছু আছে?
শামসুল হক: শিক্ষা বলতে আমি মনে করি, ইউনিয়নে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ ও মনোনয়ন দেওয়া দুটোই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় কমিটির ওপর জোর দিতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে এর বিকল্প নেই। আমরা ভালো ভালো লোক দিয়ে কমিটি করতে পারি। গ্রহণযোগ্য মানুষদের নিয়ে কমিটি করলে জনপ্রিয়তা বাড়বে।