ভরা বর্ষায় বৃষ্টির দেখা নেই, বিপাকে কৃষক

ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামের কৃষকেরা আমন চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। পাট জাগ দেওয়া নিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই।

এখন শ্রাবণ মাস চললেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে খেতে পানি নেই। চিন্তিত কৃষকেরা।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলা দিনপঞ্জির হিসাবে শ্রাবণ মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এই ভরা বর্ষাতেও স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা নেই রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায়। কখনো টিপ টিপ, কখনো একপশলা বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামের কৃষকেরা আমন ধান চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পাট জাগ দেওয়া নিয়েও কৃষকের ভোগান্তির শেষ নেই।

কৃষি বিভাগ বলছে, আমনের চারা রোপণের উপযুক্ত সময় আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহ থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। এবার মৌসুমের শুরু থেকেই স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা পাচ্ছেন না কৃষক। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে খেতে সেচ দিতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে। আবার খেতে আগাছা, রোগ ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যাবে। এতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের (২০২০) জুনে তেঁতুলিয়ায় ৮০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
রেকর্ড করা হয়। জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১ হাজার ১২৯ মিলিমিটার। এ বছরের জুনে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪২৩ মিলিমিটার এবং জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭৮৯ মিলিমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কৃষিবিদ ও আবহাওয়াবিদেরা।

গতকাল শনিবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদ মাথায় নিয়ে আমনের চারা লাগানোর কাজ করছেন কৃষিশ্রমিকেরা। চারা লাগানো হয়েছে এমন অনেক জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সেচ দিয়ে ধান লাগানো হলেও দুই দিন পর জমিতে পানির টান পড়ছে। প্রচণ্ড রোদে লালচে হয়ে যাচ্ছে ধানের গাছ।

ফুলবাড়ী উপজেলার খয়েরবাড়ি এলাকার কৃষক রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘আগে দেখেছি বাপ-দাদারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খেতে আমন ধান লাগাইত। আর এখন রোদের মধ্যে ধান লাগাচ্ছি, গা পুড়ে যাচ্ছে। এত খরা কোনো দিন দেখিনি।’

চিরিরবন্দর উপজেলার বিন্যাকুড়ি এলাকার পাটচাষি হবিবুর রহমান এবার ২৫ কাঠা জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন। তিনি বলেন, এখন পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না। প্রথমে সেচ দিয়ে খাল ভরাট করে জাগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পাট ঠিকমতো পচার আগেই পানি শুকিয়ে যায়।

গত বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, একরের পর একর জমি পড়ে আছে। সেগুলোতে আগাছা জমে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা এলাকায় দেখা যায় কৃষক মজিবর রহমান জমিতে সেচ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় জমি তৈরি ও চারা লাগাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে প্রতি শতাংশ ৩০ টাকা হারে খরচ করে পানি দিচ্ছেন।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র রায় বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত খুব কম। তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে।

পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টির অভাবে উঁচু জমিগুলোতে এখনো আমনের চারা রোপণ করতে পারেননি কৃষকেরা। যেসব জমিতে চারা রোপণ করেছেন, তারও পানি শুকিয়ে মাটি ফেটে যেতে শুরু করেছে। অধিকাংশ কৃষক এসব খেতে এখন সেচ দিচ্ছেন শ্যালো যন্ত্র বা বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে।

গত পাঁচ দিন ঠাকুরগাঁও সদর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে ধানের চারা রোপণ করছেন। আবার কোথাও কোথাও শুকিয়ে যাওয়া খেত রক্ষায় কৃষকেরা সেচ দিচ্ছেন।

সদর উপজেলার সাসলাপিয়ালা গ্রামের কৃষক মো. আলমগীর (৪২) জানালেন, বৃষ্টির পানির আশায় জমিতে হালচাষ করে রেখেছিলেন। কিন্তু তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। চারা রোপণের সময় পেরিয়ে গেলে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কায় সেচ দিয়ে ধানের চারা রোপণ করছেন তিনি। এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে হলে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, পানির অভাবে হঠাৎ গাছগুলো থমকে গেছে। এবার সেচযন্ত্র দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে। এরপরও দ্রুতই জমি ফেটে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু হোসেন বলেন, গত বছর এ সময়ে ৬৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। কিন্তু এবার হয়েছে ১৯০ মিলিমিটার। এই বৃষ্টি রোপা আমন চাষের জন্য খুবই সামান্য। এ অবস্থায় কৃষকদের সম্পূরক সেচ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এতে বাড়তি খরচ হলেও উৎপাদনের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। তবে ধানগাছে যখন থোড় হয়, তখন জমিতে পানি কম হলে ফলন কমে যাবে। সে সময় কৃষককে সতর্ক থাকতে হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর]