ভাতের জন্য ছেলের হাতে মার খেয়ে ঘরছাড়া অসুস্থ রাবিয়া

রোববার দুপুরে রাবিয়াকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

তিন ছেলের কেউই ভরণপোষণের দায়িত্ব নেননি ৭০ বছর বয়সী রাবিয়ার। ভাত চাওয়ায় উল্টো এক ছেলের হাতে মার খেয়ে বাড়ি ছাড়েন অসুস্থ এ নারী। এরপর সড়কের পাশ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন জহিরুল ইসলাম নামের অপরিচিত এক ব্যক্তি।

রাবিয়া রাজশাহীর তানোর উপজেলার দেবিপুরের মৃত মো. সদুর স্ত্রী। এ দম্পতির বড় ছেলে মো. সলিল (৫৪), মেজ ছেলে ফজর আলী (৫০) ও ছোট ছেলে আজাহার আলী (৪৫)—তিনজনই ভ্যানচালক। রাবিয়ার একমাত্র মেয়ে ফিরোজা দুই বছর আগে মারা গেছেন।

গত শনিবার রাতে রাবিয়াকে হাসপাতালের কাছে সড়কের পাশের একটি চা–দোকানের পেছনে বসে থাকতে দেখেন জহিরুল ইসলাম। এরপর তিনি এক অ্যাম্বুলেন্সচালকের সহায়তায় তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের বারান্দায় রেখে আসেন। রোববার দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে তাঁরা রাবিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ওই এলাকায় তিন-চার দিন ধরে মানবেতর অবস্থায় ছিলেন রাবিয়া। এর আগে তিন দিন ছিলেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকে চলে যেতে বলা হলে তিনি হাসপাতাল এলাকায় চলে আসেন। মানুষের সাহায্য–সহযোগিতায় তাঁর দিন চলছিল।’

হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ইসমাইল হোসেন সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বছরখানেক আগে দুর্ঘটনায় এক পায়ের দুই স্থানে ভেঙে যায় রাবিয়ার। চিকিৎসায় ভাঙা হাড় জোড়া লাগলেও বয়সের কারণে এখনো ব্যথা আছে পায়ে। এ জন্য তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। অপুষ্টিজনিত দুর্বলতাও আছে তাঁর। এক্স-রে করে পায়ে ভাঙা পাওয়া যায়নি। কয়েক দিন হাসপাতালে রেখে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। শরীরে যেন শক্তি পান, এ জন্য স্যালাইন, ভিটামিন দিতে হবে।

রোববার রাতে হাসপাতালের ছয়তলায় অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে কথা হয় রাবিয়ার সঙ্গে। এ সময় রাবিয়া বলেন, আগে তিনি বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকতেন। অন্যের বাসায় কাজ করে সেই উপার্জনে চলতেন। পা ভাঙার পর একেক ছেলের কাছে একেক মাস থেকেছেন। এ জন্য তখন প্রতিবেশী মো. হাবিবুল্লাহর কাছে জমা রাখা এক লাখ টাকা তিন ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তাঁর পায়ের চিকিৎসার জন্য মাত্র ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, তাই তাঁরা আর খাওয়াতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

সর্বশেষ বড় ছেলে মো. সলিলের বাড়িতে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে তিন বেলা খাবারও দেওয়া হতো না তাঁকে। ভাতের জন্য বকাঝকা, এমনকি মারধরও করতেন সলিল। প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতেন।
কথা বলতে বলতে বারবার চোখ মোছেন রাবিয়া। বলেন, ‘বড়ই আঘাত পায়্যাছি বাবা। আর ব্যাটাদের কাছে যাব না।’

রাবিয়া জানান, ৫০ বছর আগে চার শিশুসন্তান ও তাঁকে রেখে স্বামী মো. সদু মারা যান। এরপর তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে সেই উপার্জনে ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘তখুন অনেক ভাতের কষ্ট ছিল ব্যাটা। বাড়ি বাড়ি কাম কর‍্যা গামলায় ভাত লিয়্যা আসতুন। ছ্যালাপিলার খাইতে খাইতেই শেষ হয়্যা যাইত। অনেক দিন আমি না খাইয়্যা থাকতুন।’

মুঠোফোনে কথা হয় রাবিয়ার মেজ ছেলে ফজর আলীর সঙ্গে। এ সময় বড় ভাই সলিল তাঁর মায়ের গায়ে হাত তোলেননি বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘মাও রাগী লোক। বড় ভাইও রাগী। টকঝক হতে হতে বড় ভাই বাড়ি থেকে বাহির হয়্যা য্যাতে কহ্যাছে, মাও রাগ কর‍্যা বাহির হয়্যা গেছে। তয় সাত মাস আগে মায়ের পায়ে বড় ভায়ের লাথ লাগ্যা যায়। এ লিয়্যা গায়ে সালিস-বিচারও হয়্যাছে। বিচারে বড় ভাই মায়ের হাত ধর‍্যা মাফও চ্যাহাছে।’

প্রতিবেশী কলেজশিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহর কাছে রাবিয়ার বর্ণনা করা সবটা জানানো হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাবিয়ার বলা কথায় সত্যতা আছে। আমার কাছে রাবিয়ার জমা করা এক লাখ টাকা ছিল। এ টাকা রাবিয়া নিজের গরু-বাছুর বিক্রি করে ও মানুষের কাছ থেকে পেয়ে জমিয়েছিলেন। পা ভাঙার পর ছেলেদের টাকা ভাগ করে দিয়ে তাঁদের কাছে থাকতে লাগলেন। এখন জমানো টাকা ফুরিয়ে গেছে। ছেলেদের কাছে রাবিয়ার কদরও ফুরিয়ে গেছে।’

তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পংকজ চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না। এখন অবহিত হলাম। ওই বাড়িতে গিয়ে সব জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’