ভোলায় ফিটনেসহীন লঞ্চে তিন গুণ ভাড়ায় পারাপার
ভাটার সময় নৌপথটির সর্বোচ্চ দূরত্ব দাঁড়ায় ১৬ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ৩০ পয়সা। এ হারে ভাড়া হয় ৪০ টাকা ৮০ পয়সা। সেখানে ইজারাদার ভাড়া নিচ্ছেন ১২০ টাকা। শুধু বেশি ভাড়া নিচ্ছেন এমন নয়, লঞ্চে উঠতে প্রতি যাত্রীকে কাটতে হয় ১০ টাকার ঘাটটিকিট। অথচ যাত্রী পারাপারে ব্যবহার করা হচ্ছে দুটি ফিটনেসবিহীন লঞ্চ। যাত্রীদের জুলুমের এই চিত্র মেঘনা নদীর নতুন স্লুইস (চরফ্যাশন)-জনতাবাজার (মনপুরা) আন্ত-উপজেলা নৌপথে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেখানে সি-সার্ভে বে ক্রসিং নৌযান (সমুদ্রে চলতে পারে এমন নৌযান) চলার কথা, সেখানে যাত্রীদের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে তিন গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে ভাঙাচোরা লঞ্চে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। ভোলার অভ্যন্তরীণ নৌপথে একই দূরত্বের অন্যান্য ঘাটে ভাড়া নিচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। নতুন স্লুইস-জনতাবাজার নৌপথে বাড়তি ভাড়া নিয়ে ঘাট-সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করলে উল্টো ধমক খেতে হয় যাত্রীদের। লঞ্চস্টাফদের ভাষ্য, তাঁরা দেড় কোটি টাকায় ঘাট ডাক এনেছেন।
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল নোমান বলেন, এই নৌপথের দুরবস্থার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। অতিরিক্ত ভাড়া ও অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তবে মনপুরা উপজেলার ইউএনও শামীম মিঞা বলেন, ওই নৌপথে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়াসহ অনিয়ম-দুর্নীতি রুখতে ২০২১ সালে একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ঘাটটিকিটের বিক্রেতা ও লঞ্চমালিকের ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তখন ১০০ টাকা থেকে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ টাকা।
মনপুরা ইউএনও আরও বলেন, কখন আবার ১২০ টাকা ভাড়া নেওয়া শুরু হয়েছে, তা তিনি জানেন না। কেউ অভিযোগ করেননি। মনপুরাবাসী জিম্মি। তারা বাধ্য হয়ে এ ফিটনেসবিহীন লঞ্চে চড়ছে। এ নৌপথে একটি মানসম্পন্ন নৌযান চলা উচিত।
বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরমাদ্রাজ ইউনিয়নের নতুন স্লুইসগেট থেকে মনপুরা উপজেলার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। ডুবোচরের কারণে সর্বোচ্চ ১৬ কিলোমিটার হতে পারে। এ নৌপথের জন্য ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ নতুন ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রতি কিলোমিটারে লঞ্চভাড়া ছিল ১ টাকা ৭০ পয়সা। এই ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা। নতুন স্লুইস-জনতাবাজার নৌপথের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার ধরলে ভাড়া হয় ৪০ টাকা ৮০ পয়সা। আর প্রকৃত ১২ কিলোমিটারের ভাড়া হয় ২৭ টাকা ৬০ পয়সা।
কত টাকায় ঘাট ইজারা নিয়েছেন, তা বলতে চাননি ঘাট ইজারাদার সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁরা কয়েকজন ভাগে ঘাটটি চালাচ্ছেন। আগে থেকেই এ নৌপথে ভাড়া ছিল ১০০ টাকা। তেলের দাম বাড়ার কারণে ১২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যখন জোয়ার থাকে তখন দ্রুত গন্তব্যে যাওয়া যায়। ভাটার সময় নদীর মধ্যে ডুবোচরের কারণে অনেকখানি ঘুরে যেতে হচ্ছে। এ কারণে ১২০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন।
জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে জানা যায়, দুটি ঘাট ইজারা নিয়েছেন সিরাজুল। একটি চরফ্যাশন উপজেলার আয়েশাবাগ বেতুয়া (নতুন স্লুইসঘাট) থেকে মনপুরা উপজেলার দোহারা খাল (জনতাবাজার) পর্যন্ত। এ নৌপথের ইজারামূল্য ৬ হাজার ২৯২ টাকা। আরেকটি নৌপথ মনপুরা উপজেলার দোহারা খাল থেকে চরফ্যাশন আসলামপুর ইউনিয়নের আয়শাবাগ পর্যন্ত। এ নৌপথের ইজারামূল্য পাঁচ হাজার টাকা। বৈশাখে (১৪২৮) ইজারা নিয়ে নতুন স্লুইসগেট-জনতাবাজার নৌপথ নাম দিয়ে দুটি দেড়তলা লঞ্চ চালু করা হয়।
মনপুরা হাজিরহাটের চর ফয়জুদ্দিন গ্রামের বাসিন্দা যাত্রী ইলিয়াছ মুন্সি বলেন, ‘এট্টু নড়াচড়া করলে লঞ্চ কাঁইপ্পা ওডে। এমন লঞ্চে চড়তেও ভয় লাগে।’ এই নৌপথের লঞ্চে চড়া নিয়ে ভয়ের কথা জানালেন অন্য যাত্রীরাও।
বিআইডব্লিউটিএর ভোলা নদীবন্দরে কর্মরত নৌ নিরাপত্তা বিভাগের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, নতুন স্লুইসগেট-জনতাবাজার নৌপথে চলা লঞ্চ দুটির কোনো ফিটনেস সনদ নেই। তিনি বিষয়টি বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে জানিয়েছেন। এ নৌপথ সারা বছরই নদী উত্তাল থাকে। এখানে বছরের সাত মাস (১৫ মার্চ-১৫ অক্টোবর) সি-সার্ভে সনদধারী বে ক্রসিং নৌযান ছাড়া অন্য নৌযান চলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নতুন স্লুইস-জনতাবাজার নৌপথে স্পিডবোটও চলাচল করে। স্পিডবোটে যাত্রী তুললে লঞ্চমালিককে জনপ্রতি ১০০ টাকা দিতে হয়। ঘাটের টিকিট বিক্রেতাকে দিতে হয় ১০০ টাকা। স্পিডবোটে যাত্রীপ্রতি পারাপারে খরচ পড়ে ৩০০ টাকা।
নতুন স্লুইসঘাট এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোস্তফা সাজির নেতৃত্বে মো. আলী, নবুমুন্সি, সিদ্দিকুর রহমান মাঝিসহ কিছু প্রভাবশালী লোক বিআইডব্লিউটিএর নামে টিকিট বিক্রি করছেন। এর মধ্যে মোস্তফা সাজি বলেন, তাঁরা বেতুয়া লঞ্চঘাটের ইজারাদারের সাবইজারাদার; সে হিসাবে টোল আদায় করছেন।
ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের সাবইজারা দেওয়া-নেওয়ার কোনো বৈধতা নেই। বিআইডব্লিউটিএর খাতায় নতুন স্লুইস লঞ্চঘাট নামে কোনো লঞ্চঘাটও নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী বিআইডব্লিউটিএর নামে টার্মিনাল টিকিট বিক্রি করছে। তা সম্পূর্ণ বেআইনি।
ভোলা জেলা প্রশাসক তৌহিদ-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, অবৈধ টিকিট বিক্রি, বেশি ভাড়া গ্রহণ, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচলসহ সব অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ভাড়া কমানোর জন্য আবার অভিযান চালানো হবে।