স্বেচ্ছাসেবীদের একজন বললেন, ‘দাদি পান্তাভাত খেতে হবে না। প্যাকেটে মুরগির মাংস, সাদা ভাত, ডাল আছে। সাহ্রি খেয়ে নিন।’ একটু পর সদ্য ঘুমভাঙা চোখে দরজা খুলতেই জরিনা বেওয়ার হাতে স্বেচ্ছাসেবীরা তুলে দিলেন সাহ্রির প্যাকেট।
গত বৃহস্পতিবার পয়লা বৈশাখের রাতে এ চিত্র বগুড়া রেলস্টেশন বস্তির। শুধু বৃহস্পতিবার রাতেই নয়; এবারের পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকেই প্রতি রাতে রেলস্টেশন এবং স্টেশনসংলগ্ন বস্তি ঘুরে ঘুরে শতাধিক অসহায় ছিন্নমূল মানুষের ঘরে ঘরে এভাবে সাহ্রির প্যাকেট পৌঁছে দিচ্ছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী। উদ্যোগটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মুক্ততারা সোসাইটি’র।
পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অসহায়, গরিব, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মুক্ততারা সোসাইটি’র স্বেচ্ছাসেবীরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
করোনা অতিমারি ও লকডাউনের শুরু থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা বগুড়া শহরের রেলওয়ে বস্তির অনাহারি ও নিরন্ন মানুষের মুখে রান্না করা খাবার তুলে দেওয়ার কাজ করছেন। গত বছরও বগুড়া রেলওয়ে বস্তির রোজাদারদের ঘরে ঘরে সাহ্রি ও ইফতারি পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া জিলা স্কুল এবং সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ নামীদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন এই ‘মুক্ততারা সোসাইটি’। অনাহারি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে তাঁরা খুলেছেন ‘মেগা কিচেন’। এই কিচেনে স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরাই প্রতিদিন রাত জেগে রান্না করছেন। এরপর সাহ্রির সময় রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন বস্তির ঘরে ঘরে। স্বেচ্ছাসেবীদের এ মানবিক উদ্যোগ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। তাঁদের উৎসাহ দিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বগুড়া শহরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী গ্রুপ আকবরিয়া লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আকবরিয়া কেয়ার’।
আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি হাসান আলী আলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একঝাঁক তরুণের এই মহতী উদ্যোগ এতটাই মুগ্ধ করেছে যে একপর্যায়ে নিজেও উদ্যোগের সঙ্গে শামিল হয়েছি। আকবরিয়া ব্যবসার পাশাপাশি শত বছর ধরে দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ ও মুসাফিরদের মধ্যরাতে আহার পরিবেশন করছে।’
মুক্ততারার শুরুর কথা
মুক্ততারা সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিউর রহমান। বগুড়া রেলওয়ে বস্তির পাশের কামারগাড়ি এলাকার এই তরুণ ২০১৭ সালে সাত–আটজন সহপাঠীকে নিয়ে পবিত্র রমজান মাসে একটি এতিমখানায় ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুক্ততারা সোসাইটির যাত্রা শুরু হয়।
নাফিউর রহমান বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা শেষে অলস বসে ছিলাম। দাদা প্রয়াত রমজান আলী এলাকার গরিব-দুঃখী মানুষের বিপদে–আপদে বন্ধু ছিলেন। দাদার পথ ধরে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মুক্ততারা সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করি।’
যেভাবে চলে মুক্ততারা
মুক্ততারার স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, প্রথম দিকে তাঁরা নিজেরাই হাত খরচের অর্থ, ঈদের জামাকাপড় কেনার টাকা বাঁচিয়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেন। এ কার্যক্রম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানাজন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে আকবরিয়া কেয়ার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় চলছে ইফতার ও সাহ্রির আয়োজন।
সরকারি আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান বলেন, প্রতিদিনই স্বেচ্ছাসেবকেরা শহরের রেলওয়ে বস্তি ছাড়াও ভাসমান ছিন্নমূল মানুষের তালিকা ও ঠিকানা সংগ্রহ করেন। এরপর রাতে মেগাকিচেন থেকে রান্না করা খাবারের ভ্যানভর্তি প্যাকেট নিয়ে রওনা দেন ঘরে ঘরে সাহ্রি পৌঁছে দিতে।
মেগা কিচেন
মুক্ততারা সোসাইটির উদ্যোগে করোনায় অসহায় মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ শুরুর পর নাফিউর রহমানের বাসায় স্থাপন করা হয় ‘মেগাকিচেন’। এখানে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য দিনরাতে চলে রান্নার আয়োজন। স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরাই রান্না করেন, নিজেরাই বাজার-সদাই করেন। দলে নেতৃত্ব দেন নাফিউর নিজেই। সরকারি আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান মেগাকিচেনের সাহ্রি আয়োজনের দায়িত্বে আছেন।
মুক্ততারা সোসাইটির উপদেষ্টা ও সরকারি আজিজুল হক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শফি মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, দরিদ্র রোজাদার ও অসহায় মানুষের কথা বিবেচনা করেই একদল শিক্ষার্থী রাত জেগে রান্না করে মাসজুড়ে সাহ্রি ও ইফতারি বিতরণ করছে। এ উদ্যোগ অনন্য ও প্রশংসনীয়।