মাতৃহারা হনুমানশাবকটি পাচ্ছে মানুষের যত্ন–ভালোবাসা
মায়ের পিঠে চড়ে গাছের ডালে ডালে ছোটাছুটি করে কাটছিল জীবন। চশমাপরা হনুমানশাবকটির বয়স তখন মাত্র তিন দিন। মুহূর্তেই বদলে যায় সবকিছু। তার মা বনের ভেতরে উন্মুক্ত বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ হারায়।
মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে হনুমানশাবকটি। উদ্ধার হওয়ার পর থেকে মানুষের যত্ন ও ভালোবাসায় সামলে উঠছে শোক। একটু বড় হলে শাবকটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বনে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের শৌচাগার এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের খোলা তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় চশমাপরা মা হনুমানটি। এ সময় শাবকটি চেঁচামেচি করে কাঁদছিল। এ দৃশ্য দেখে ওকে উদ্ধার করতে যাওয়া বনকর্মীদের চোখও সিক্ত হয়ে ওঠে। এরপর শাবকটিকে উদ্ধার করে লাউয়াছড়াসংলগ্ন জানকীছড়া রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই এখন ওর পরিচর্যা চলছে। জার্মানির প্লামপ্লরিস ই ভি নামের একটি সংস্থা হনুমানের শাবকটির লালনপালনে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বন্য প্রাণী গবেষক মো. হাসান আল রাজী আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাবকটির অবস্থা এখন ভালো। আমাদের একটা প্রাণিচিকিৎসক গ্রুপ আছে। কোনো সমস্যা হলে ওদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। শাবকটিকে দূর থেকে খাদ্য ও সেবা দেওয়া হচ্ছে, যাতে ওর বুনো স্বভাবটা থাকে এবং বড় হয়ে বনে ফিরে যেতে পারে।’
হাসান আল রাজী জানান, প্রাণিচিকিৎসকদের পরামর্শে শাবকটিকে ল্যাকটোজেন-১, গাছের পাতার কষ ও গ্লুকোজ খাওয়ানো হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর ওর শরীরের তাপমাত্রা ও ওজন পরিমাপ করে দেখা হচ্ছে। ওকে দেখাশোনার জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
চশমাপরা হনুমান বাংলাদেশে পাওয়া বানরগোত্রীয় ১০টি প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মিশ্র চিরসবুজ বনভূমিতে এগুলোর দেখা মেলে। বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন প্রজাতির হলেও বাংলাদেশে এটি মহাবিপন্ন তালিকায় রয়েছে। আবাসস্থল কমে যাওয়া প্রজাতিটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
কালো মুখমণ্ডলে শুধু চোখের চারদিকে সাদা, দেখলে মনে হয় যেন চশমা পরে আছে। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে আকারে এগুলোই ছোট। এগুলো বৃক্ষবাসী, কখনোই মাটিতে নামে না। ঘুম, চলাফেরা, খাবার সংগ্রহ, খেলাধুলা, গা চুলকানো, বিশ্রাম—সবকিছু গাছেই সম্পন্ন করে। এসব হনুমান গাছের ডালে ডালে ঘুরে পাতা, পাতার বোঁটা, ফুল, ফল ও কুঁড়ি খায়। উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বংশবৃদ্ধিতে বেশ সাহায্য করে। আয়ুষ্কাল প্রায় ২০ বছর।
হনুমানের শাবকটি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা চঞ্চল গোয়ালা আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাবকটি ভালো আছে। তবে ক্ষুধা পেলে চিৎকার করে। তখন কোলে নিয়ে আদর করে চেঁচামেচি থামাই। মায়ের আদর তো আর দেওয়া যাবে না। শান্ত হওয়ার পর ঝুড়িতে রেখে দিলে আবার চেঁচায়। তখন আমি আড়ালে চলে যাই। আমাকে না দেখলে চিৎকার বন্ধ করে দেয়। মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে এমনটা করা হচ্ছে।’
চঞ্চল গোয়ালা বলেন, গাঢ় ছায়ার মধ্যেই শাবকটিকে বেশি সময় রাখা হচ্ছে। কিছুটা সময় উন্মুক্ত স্থানে রোদে রাখা হয়, যাতে ছোটাছুটি করতে পারে। আরেকটু বড় হলে গাছে চড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে সে একসময় বনে ফিরে যেতে পারে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শাবকটিকে সবাই মিলে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।