মানুষের মতো চিকিৎসা প্রাণীদের

পায়ে খুরারোগ হওয়া গরুর বাছুরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই বাছুরটিকে আনা হয়েছে নগরের বহদ্দরহাট থেকে। গতকাল দুপুরে ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতালে।  জুয়েল শীল
পায়ে খুরারোগ হওয়া গরুর বাছুরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই বাছুরটিকে আনা হয়েছে নগরের বহদ্দরহাট থেকে। গতকাল দুপুরে ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতালে। জুয়েল শীল

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রোপচার কক্ষটির ভেতরে নানা আধুনিক যন্ত্র। তার মাঝখানের স্ট্রেচারে শোয়া বিড়ালটি। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বিড়ালটি ঘিরে মাস্ক আর গ্লাভস পরা পাঁচ চিকিৎসকের ব্যস্ততা। কেউ সেলাই করছেন। কেউবা গরম জল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন কাটা স্থানের রক্ত-পুঁজ।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এস এ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতালে’ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এই দৃশ্য দেখা যায়। বিড়ালটির বন্ধ্যাকরণ করা হচ্ছিল। রোগীর তালিকায় কখনো থাকে গরু–ছাগল আবার কখনো বা কুকুর-বিড়াল। বাদ পড়ে না মুরগি-কবুতর থেকে বিদেশি পাখিও।

চিকিৎসকদের দাবি, একটি হাসপাতালে মানুষেরা যেভাবে চিকিৎসাসেবা পান এখানে প্রাণী আর পাখিদের সেভাবে সেবা দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০০টি প্রাণী ও পাখিকে এখানে চিকিৎসা দিতে আনেন মানুষেরা।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও প্রাণী আর পাখি নিয়ে এখানে ছুটে আসেন মানুষ। ১০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে এখানে মেলে চিকিৎসাসেবা। ছুটির দিন ছাড়া এখানে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। শনিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ হাসপাতাল।

প্রিয় পোষ্য বিড়ালটির বেশ কয়েক দিন ধরে কাশি। নাক দিয়েও পানি ঝরছে। গতকাল দুপুরে বিড়ালকে চিকিৎসা দিতে নগরের সিটি গেট থেকে হাসপাতালে এসেছেন সামিয়া শারমিন ও তাহমিদা তাসনিম নামের দুই বোন।

বহদ্দারহাট এলাকা থেকে গরুর বাছুরকে নিয়ে এসেছেন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাছুরের পায়ের ক্ষুরারোগ হয়েছে। এর ফলে পচনের কারণে পোকা ধরে গেছে। ফলে হাঁটতে পারছিল না। সেটির চিকিৎসা দিতে বাছুরকে এনেছিলাম। বেশ ভালো চিকিৎসা পেয়েছে।’

সব ধরনের চিকিৎসাসেবা

এ হাসপাতালে প্রাণী ও পাখির সব ধরনের চিকিৎসাসেবা অর্থাৎ মেডিসিন, সার্জারি ও প্রসবসংক্রান্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। মোট নয়ভাবে এই সেবাকে ভাগ করেছেন চিকিৎসকেরা। রোগনির্ণয় থেকে শুরু করে প্রসবজনিত সমস্যা, কৃত্রিম প্রজনন, দাঁতের চিকিৎসা কিংবা জটিল রোগের অস্ত্রোপচার—সবকিছুরই চিকিৎসা হয়।। এর পাশাপাশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এক্স-রে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি, সিএস টেস্ট, অ্যান্টিবডি-টাইটার টেস্টসহ সব রকমের পরীক্ষাও হয় এ হাসপাতালে। একই সঙ্গে পোলট্রি ও দুগ্ধ খামার স্থাপনে প্রয়োজনীয় উপদেশ, পরামর্শ ও নির্দেশনাও দেন এখানকার চিকিৎসকেরা।

কয়েক বছরের চিত্র

এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরের চিত্র পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালে এ হাসপাতালে ৪ হাজার ৮০৬টি প্রাণী ও পাখিকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৯৬২, ২০১৭ সালে ৬ হাজার ২২০ এবং ২০১৮ সালে ৭ হাজার ২২টি প্রাণী ও পাখি চিকিৎসাসেবা পায়। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা পেয়েছে ৪ হাজার ১০৩টি প্রাণী ও পাখি। এই পাঁচ বছরে হাসপাতালের আয় হয়েছে ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৫৪৫ টাকা।

টিনশেড থেকে ৫ তলা ভবন

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ হিসেবে। সেটি ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকের কথা। তখন থেকে শুরু হয় এ হাসপাতালের যাত্রাও। কয়েক বছরের মাথায় সেই ছোট্ট হাসপাতালটি রূপ পায় পাঁচতলা ভবনে।

হাসপাতালে কথা হয় বর্তমান পরিচালক ভজন কান্তি দাস এবং সাবেক পরিচালক মো. রায়হান ফারুকের সঙ্গে। এই দুই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, একজন অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে যেভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়, সেভাবেই যত্ন নিয়ে তাঁরা প্রাণী ও পাখির চিকিৎসা করেন। জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গঠন করা হয় মেডিকেল বোর্ডও। রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তো আছেই। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি সপ্তাহে দুদিন চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেন তাঁরা।