মাশরুমে গোলাপীর রঙিন জীবন

বিভিন্ন চায়নিজ রেস্তোরাঁর মালিক ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক বাড়িতে এসে মাশরুম কিনে নিয়ে যান।

মাশরুম পরিচর্যায় ব্যস্ত গোলাপি। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

শরীরের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন গোলাপী বেগম (৪৫)। বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও সুস্থ হননি। শেষে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার এক শল্যচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। সেখানে দেখেন, ওই চিকিৎসক মাশরুম ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন। পাশাপাশি বাড়িতে মাশরুম চাষ করেন। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন গোলাপী। ওই চিকিৎসকের বাড়িতে যাতায়াতের সময় মাশরুম চাষের পদ্ধতি ও কৌশল রপ্ত করেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, নিজেও মাশরুম চাষ করবেন।

গত এক বছর ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে বীজ নিয়ে নিজ বাড়িতে মাশরুম চাষ করছেন গোলাপী। ঘরের ভেতরে প্রথমে ৮১টি স্পন দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করেন। স্পন হচ্ছে মাশরুমের বীজ বা সেদ্ধ করা শস্যদানা বা খড়ের ওপর জন্মানো ছত্রাক। কিন্তু গোলাপী পলিথিনের মধ্যে খড়-বীজ পুরে বাঁধানো প্যাকেটকে একেকটি স্পন বলছেন।

প্রথম তিন মাসে মাশরুম চাষ করে গোলাপী খরচ বাদে প্রায় ১৬ হাজার টাকা লাভ করেন। গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে তাঁর আয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। বাড়িতে থেকেই তিনি এ আয় করেন। বিভিন্ন চায়নিজ রেস্তোরাঁর মালিক ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক বাড়িতে এসে মাশরুম কিনে নিয়ে যান। বর্তমানে গোলাপীর মাশরুম চাষের পরিধি আরও বেড়েছে। এখন প্রতি মাসে গড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি।

গোলাপীর বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আধা পাকা টিনশেড ঘরে পলিথিনের প্যাকেটগুলো একটার ওপরে আরেকটা থরে থরে সাজানো। সেগুলো ঝুলছে। পলিথিন ফুঁড়ে বেরিয়েছে মাশরুম। মাশরুম পরিচর্যায় ব্যস্ত গোলাপী। এ সময় গোলাপী মাশরুম চাষে উৎসাহিত হওয়ার পেছনের গল্প শোনান।

মানবদেহের নানা জটিল রোগের চিকিৎসায় মাশরুমের ব্যবহার করা হয়। আমি নিজে মাশরুম খেয়ে জটিল রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
গোলাপী বেগম, সফল মাশরুম চাষি

গোলাপী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবদেহের নানা জটিল রোগের চিকিৎসায় মাশরুমের ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া মাশরুম রান্না করে খাওয়া যায়। আমি নিজে মাশরুম খেয়ে জটিল রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ গোলাপী জানান, শুরুতে ৮১টি স্পন দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করলেও বর্তমানে তাঁর ঘরে স্পন রয়েছে আড়াই হাজার। প্রতিটি স্পন তৈরিতে গড়ে ৪০ টাকা খরচ হয়েছে।

গোলাপী প্রথম আলোকে বলেন, মাশরুম চাষে ঝামেলা ও পরিশ্রম কম। সংসারের কাজের ফাঁকে বাড়িতে মাশরুম চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। বর্তমানে আমার দেখাদেখি গ্রামের অনেক নারী মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে গ্রামের ১১ নারী মাশরুম চাষ করে সংসারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনন্তপুর গ্রামের শিল্পী, রিপা, পারভিনা, সুলতানা, মর্জিনাসহ ১১ নারী বাড়িতে মাশরুম চাষ করে অভাবের সংসারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন। পারভিনা জানান, তিনি বাড়িতে মাশরুম চাষ করে মাসে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছেন।

গোলাপীর স্বামী আকতারুল ইসলাম সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে কলেজে ও এক মেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করছে। গোলাপী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পেছনে প্রতি মাসে অনেক খরচ। আমি এসএসসি পাস করেছি। স্বামীর চাকরির টাকায় সংসারের খরচ মেটানো দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। অবসর নেওয়ার পরে সেটি আরও প্রকট হয়। সংসারে হাবুডুবু অবস্থা। অন্যদিকে নানা রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। তবু থেমে যাইনি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সাহস নিয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছি, পেয়েছিও। মাশরুম চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে পেরেছি। সন্তানদের পড়াশোনায় খরচ জোগাতে এখন আর টেনশন নেই।’

দাঁত ও হাড় গঠনে মাশরুমের কার্যকারিতা ব্যাপক। হাইপার টেনশন দূর হয়, মেরুদণ্ড দৃঢ় রাখে।
ফাতেমা তুজ জোহরা, পুষ্টিবিদ

আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘অবসরজীবন কষ্টের। আমি চাকরি করে সংসারে অর্থনৈতিক দৈন্য ঘোচাতে না পারলেও, গোলাপী বাড়িতে বসে মাশরুম চাষ করে সেই অভাব দূর করেছে। স্ত্রী-ই আমার লক্ষ্মী।’

পুষ্টিবিদ ফাতেমা তুজ জোহরা প্রথম আলোকে বলেন, মাশরুম পুষ্টিতে ভরপুর। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ও প্যাকেজিংয়ের কারণে তা নিরাপদও। মাশরুমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ডি আছে। হেপাটাইটিস বি, জন্ডিস, ক্যানসার, টিউমার, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, কিডনি, হৃদরোগসহ নানা রোগ নিয়ন্ত্রণ করে মাশরুম। খাদ্য হজমে ও ওজন কমাতে সহায়তা করে। দাঁত ও হাড় গঠনে মাশরুমের কার্যকারিতা ব্যাপক। হাইপার টেনশন দূর হয়, মেরুদণ্ড দৃঢ় রাখে। মাশরুমে থাকা নিয়াসিন ও রিবোফ্লোবিন ত্বকের জন্য উপকারী। এই ছত্রাকে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পানি থাকে। এতে ত্বক নরম ও কোমল থাকে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসসুম প্রথম আলোকে বলেন, মাশরুম ছত্রাকজাতীয় উদ্ভিদ। পুষ্টিগুণে ভরা। গোলাপীর চাষ করা মাশরুমের ক্রেতা তিনিও। মাশরুম চাষে তাঁর সফলতা দেখে গ্রামের অন্য নারীরাও মাশরুম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁরা সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।