একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা সেলাই করা হচ্ছে। উৎসুক জনতা ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই দৃশ্য। এ রকম সাদা-কালো একটি ছবির কথা অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে। ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ী সেই ছবি ১৯৭১ সালে তুলেছিলেন খ্যাতিমান ফরাসি আলোকচিত্রী মার্ক রিবু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আরও বেশ কিছু ছবি তুলেছিলেন তিনি। সেসবের কিছু অদেখা ছবি এখন ঢাকায়।
আজ শনিবার বিকেল চারটায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শুরু হচ্ছে মার্ক রিবুর একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘বাংলাদেশ ১৯৭১: শোক ও সকাল’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর তোলা বেশ কিছু অপ্রকাশিত ছবি দেখা যাবে সেখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে যৌথভাবে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা। আয়োজনে সহায়তা করছে লা সেসিও লেসামি দ্য মাখ রিব্যো ও গিমে মিউজিয়াম।
আইফেল টাওয়ারে কাজ করছেন একজন রংমিস্ত্রি। ১৯৫৩ সালে মার্ক রিবুর তোলা এ রকম একটি ছবি প্রকাশ করে লাইফ ম্যাগাজিন। এ ছবিই তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। তারপর অঁরি কাখতিয়ের-ব্রেসন এবং রবার্ট কাপার আমন্ত্রণে তিনি যোগ দেন ম্যাগনাম ফটোতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সড়কপথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে আসেন। ছিলেন অনেক দিন। ১৯৫৭ সালে কলকাতা থেকে প্রথমবারের মতো যান বেইজিং। পরে আরও বেশ কবার। সেখানেও ছিলেন অনেক দিন। জাপানেই তিনি খুঁজে পান অনুপ্রেরণা। দূর ও মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের পর সেই অনুপ্রেরণায় তিনি লেখেন বই—‘জাপানের নারীরা’।
সোভিয়েত ইউনিয়নে তিন মাস কাটিয়ে ১৯৬০ সালে মার্ক রিবু আলজেরিয়া ও সাব-সাহারা আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের ছবি তোলেন। ১৯৬৮ ও ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময় তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছিলেন। খুব কম আলোকচিত্রী এ সুযোগ পেয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে পেন্টাগনের সামনে আন্দোলন চলাকালে তাঁর তোলা ফুল হাতে এক তরুণীর ছবি শান্তির আন্তর্জাতিক প্রতীকে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম মার্ক রিবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি কলকাতা যান। শরণার্থীশিবির ও মুক্তাঞ্চল ঘুরে দেখেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন।
জামালপুর-শেরপুর হয়ে তিনি যাত্রা করেন। ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে জামালপুরের বিজয়ের মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করেন। সে সময় তিনি ছিলেন অন্যতম আলোকচিত্রী, যাঁর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী হয় তৎকালীন ঢাকা। সে রকম অনেক ছবি এখনো রয়েছে অপ্রকাশিত।
মার্ক রিবুর জন্ম সাঁ-জেনি-লাভালে, ১৯২৩ সালে। ১৪তম জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ছোট্ট ভেস্ট পকেট কোডাক ক্যামেরা। সেটি দিয়েই তিনি শুরু করেন কাজ। ১৯৪৪ সালে হানাদার নাজি বাহিনীর বিরুদ্ধে ভেখকোর প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি লিঁওর ইকোল সনথ্রালে প্রকৌশলবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিন বছর পরই পেশা পরিবর্তন করেন, হয়ে যান আলোকচিত্রী।
১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে মার্ক রিবু প্রায়ই ফিরে যেতেন প্রাচ্যে ও দূরপ্রাচ্যে, বিশেষ করে অ্যাংকর ও হুয়াং-শানে। চীনের দ্রুত ও গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরগুলো দেখেছেন তিনি। এ রকম একটি জাতিকে ৩০ বছরের বেশি সময় খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে তোলা ১৯২টি আলোকচিত্রের মূল প্রিন্ট প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে (সেন্টার জর্জ পম্পেদু) সম্প্রদান করেন তিনি।
তাঁর ছবি পেয়েছে বহু সম্মাননা। প্রদর্শিত হয়েছে প্যারিস, নিউইয়র্ক, সাংহাই ও টোকিওর মতো বড় বড় শহরের নামীদামি জাদুঘর ও গ্যালারিতে। মার্ক রিবু ২০১৬ সালে ৯৩ বছর বয়সে প্যারিসে মারা যান।
‘বাংলাদেশ ১৯৭১: শোক ও সকাল’ প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত। রোববার বাদে সোম থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রদর্শনী ঘুরে আসা যাবে। যৌথভাবে প্রদর্শনীর বাছাই-বিন্যাস করেছেন মফিদুল হক ও লরেন ড্রুরে। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ছবিগুলো নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রদর্শনী হবে জানুয়ারি মাসে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে।