মেঘনার তীরে বাণিজ্যে বসতি

মেঘনা তীরের এই নৌবন্দরের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা হলো সার, রড–সিমেন্ট, পাথর, ধান–চাল ও পরিবহন। এসব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ। প্রতিদিন এখানে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সে হিসাবে মাসে দেড় হাজার কোটি টাকার এবং বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা–বাণিজ্য হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দরে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক, মালিক ও আড়তদার কর্মব্যস্ত সময় পার করেন
ছবি: প্রথম আলো

মেঘনা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর। এই নৌবন্দর ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে রড-সিমেন্ট, গম, পাথর, সার, বালু, পদ্মা অয়েল, ধান-চাল ও পরিবহনসহ অসংখ্য ব্যবসা। এসব ব্যবসার সঙ্গে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। পরিবারের সদস্য যোগ করলে যা চার থেকে পাঁচ গুণের বেশি দাঁড়াবে। প্রতিদিন এই নৌবন্দরে কম করে হলেও ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সে হিসাবে মাসে দেড় হাজার কোটি টাকা এবং বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।

জেলা তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, আশ ও গঞ্জ থেকে আশুগঞ্জ নামের উদ্ভব। আশ অর্থ আউশ ধান আর গঞ্জ অর্থ নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যকেন্দ্র বা হাটবাজার। মেঘনা নদীর তীরে আউশ ধান কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে একটি গঞ্জ গড়ে উঠেছিল। এর পর থেকে জায়গার নাম হয় আশুগঞ্জ। আয়তনের দিক থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে ছোট উপজেলা এটি। ১৮৯৮ সালে আশুগঞ্জের গোড়াপত্তন। ১৯৮৪ সালের ২৮ নভেম্বর আশুগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালের ২৩ অক্টোবর আশুগঞ্জ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

নৌবন্দরের পাশাপাশি আশুগঞ্জে ১১টি কেপিআইভুক্ত (রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ) প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো হলো আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল), আশুগঞ্জ সার কারখানা, আশুগঞ্জ গ্যাস কম্প্রেসর স্টেশন লিমিটেড (জিটিসিএল), আশুগঞ্জ পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, খাদ্যগুদাম (সাইলো), রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি, গ্যাস ম্যানিফোল্ড স্টেশন, আশুগঞ্জ-ভৈরব মেঘনার ওপর দুটি রেলসেতু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতু ও বেসরকারি মিডল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। এপিএসসিএল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাতটি প্ল্যান্ট থেকে জাতীয় গ্রিডে ১ হাজার ৫৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্প বণিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, আশুগঞ্জ নৌবন্দরের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা হলো সার, রড-সিমেন্ট, পাথর, ধান-চাল ও পরিবহন। আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে ডিলাররা সার সরবরাহ করে বন্দরে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আওতাভুক্ত সাত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে সার পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা টিএসপি, ডিওপি ও এমওপিসহ খোলা সার বন্দরে পৌঁছায়। পরিবহনের দায়িত্বে থাকা ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে দেশের ২৫টি জেলার বিএডিসিতে এসব সার পাঠান। প্রতিদিন বন্দরে সার, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামালের গড়ে ৫০-৬০টি জাহাজ ভিড়ে।

অপরদিকে ধানের মোকামে ময়মনসিংহ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ধানের ব্যাপারীরা শতাধিক নৌকা নিয়ে আসেন। ধান-চালের ব্যবসাকে ঘিরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক চাতাল ও ২২টি ড্রাই রাইস মিল আছে। প্রতিটি চাতালে অর্ধশতাধিক এবং ড্রাই রাইস মিলে শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। বন্দর ও মেঘনার ধানের মোকামে এসব মালামাল জাহাজ থেকে ট্রাকে তোলার কাজে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সারের প্রতি বস্তা থেকে একজন শ্রমিক সাড়ে ৬ টাকা, সিমেন্টের বস্তা থেকে ৬ টাকা, ধানের গোলা থেকে বস্তায় ধান ভর্তে একজন শ্রমিক সাড়ে ৯ টাকা পান।

আশুগঞ্জ শিল্প বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সব মিলিয়ে বন্দর ঘিরে ব্যবসায়ী-শ্রমিকসহ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষের জীবিকার চাকা ঘুরে। প্রতিদিন এখানে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেন সড়কের উন্নয়নকাজ শেষে বন্দরের ব্যবসা আরও বড় হবে বলে আশা তাঁর।

নৌবন্দরে সার, সিমেন্ট ও ধানের বস্তা ওঠানো-নামানোর কাজ করেন শাহাজাহান মিয়া, আশ্রাব উদ্দিন, মো. আলামিন, মো. আলমগীর, মন্তাজ মিয়া, আলম মিয়া, আনু মিয়া, এনামুল হকসহ অনেক শ্রমিক। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একজন শ্রমিক সপ্তাহে গড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় করতে পারেন। সে হিসাবে মাসে একজন শ্রমিকের আয় ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা।

বন্দরের ব্যবসায়ী নাসির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরে সব মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য জেটি মাত্র একটি। এ কারণে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে অনেক সময় লেগে যায়। নৌযানগুলোকে বন্দরে নোঙর করে অপেক্ষায় থাকতে হয়। আরও জেটি নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

আশুগঞ্জের পরিবহন ঠিকাদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ইব্রাহীম মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক রুমেল মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার ট্রাকে বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করা হয়। ট্রাকপ্রতি ঠিকাদারেরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে পরিবহন চার্জ পান। গড়ে প্রতিদিন পরিবহন চার্জ হিসাবে ঠিকাদারেরা ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পান।

ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জারু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ধান ও চাল আশুগঞ্জের প্রাণ। ধান-চাল থাকলে বাজার জমে। না থাকলে বাজার বসে যায়। আশুগঞ্জ থেকে চালের বিরাট একটি অংশ সারা দেশে যায়। ধান-চালেই প্রতিদিন প্রায় ৩০ কোটি টাকা লেনদেন হয়।

যে নৌবন্দর ঘিরে এত কিছু, আন্তদেশীয় নৌ-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ২০০৮ সালে সেটাকে ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করা হয়। আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে ২০১১ সাল থেকে নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা ট্রানজিট শুরু হয়। এর আগের বছর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে একনেকের সভায় আশুগঞ্জ বন্দরের উন্নয়নে প্রায় ২৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রায় ১০০ বিঘা জমির ওপর হতে যাওয়া এই প্রকল্পে তিনটি আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল জেটি, কনটেইনার টার্মিনাল, ক্রেন ইয়ার্ড, ওয়্যার হাউস, ইলেকট্রিক সাবস্টেশন, ট্রাক ইয়ার্ড, কাস্টমস হাউস, বিআইডব্লিউটিএ ও বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যালয়, রেস্ট হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কথা। এটি বাস্তবায়িত হলে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি আশুগঞ্জে আসতে পারবে। বাড়বে বন্দর ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য।