যমুনার চরে সহিতন-ইউসুফের জলে ভাসা সংসার

যমুনা নদীর পানি বেড়ে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন মানুষ। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাট শেরপুর এলাকায়
ছবি: সোয়েল রানা

ঘরের ভেতরে বুকসমান পানি। উঠান-বারান্দা, আঙিনায় বইছে প্রবল স্রোত। পানিতে ভিজে সয়লাব ধান-চাল-ডাল-বাদাম, বিছানা-বালিশ। যমুনা নদীর নির্জন চরে অর্ধেক ডুবে যাওয়া টিনের বেড়ার ঘরের দুয়ারে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে গৃহবধূ সহিতন বেগম (২৪)। কোলে ছয় মাস বয়সী ফাতেমা। ঘরের দুয়ারে ভিড়েছে ডিঙি। স্বামী ইউসুফ আলী (৩৮) বুকসমান পানিতে নেমে অর্ধেক ডুবে যাওয়া ঘর থেকে ঘটিবাটি, বিছানা–বালিশ নৌকায় তুলছেন।

আজ সোমবার দুপুরে সহিতন-ইউসুফ ব্যাপারীর জলে ভাসা এ সংসারের চিত্র দেখা গেল বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের খাটিয়ামারি (কাশিরপাড়া) চরে।

সহিতন বেগম বলেন, ‘আট দিন ধরে ঢলের সাথে লড়াই করিচ্চি। কোলোত ছয় মাসের দুধের ছল। চুলা জলাবার উপায় নাই। জলে ভাসা সংসার। শুকনা মুড়ি-চিড়া-বিস্কুট খায়্যা আটটা দিন কাটাচি। দুধের ছলডাক লিয়ে আর পারিচ্চি না। জলভাসা সংসারডা ছাড়ে ডিঙ্গি লৌকাত গাঙ পারের দিকে যাচ্চি।’

বন্যার পানির সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে আজ দুপুরে সহায়–সম্বল নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দিকে রওনা হয় পরিবারটি।

জাহেদা বেগমের বাড়িতে হাঁটুসমান পানি। সেখানে একটি চৌকির ওপর রান্না করছেন তিনি। আজ সোমবার বেলা ১১টায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দীঘাপাড়া চর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ইউসুফ ব্যাপারী বলেন, ‘শত্রুর সাথে লড়াই করে জেতা যায়। যমুনার সাথে লড়াইয়ে টিকা যায় না। বর্ষায় ভয়ংকর যমুনা। আট দিন ধরে জলে ভাসা সংসার। বানের পানিত কলডা ডুবে গেচে। খাবার পানি নাই। ঘরত বুকসমান পানি। দুধের ছলডাক লিয়ে বউ মাচার ওপর বসে থাকে। ঘুম নাই। আর পারিচ্চি না। সবকিছু লিয়ে বাঁধের দিকে যাচ্চি।’
ইউসুফ ব্যাপারীর যেখানটায় বসবাস, অদূরেই যমুনা নদী। যমুনার ঢল আছড়ে পড়ছে বসতঘরে। খাটিয়ামারির মূল লোকালয় থেকে দূরে; নদীতীরবর্তী নির্জন স্থানে বসবাস ৯-১০টি পরিবারের।

ইউসুফ ব্যাপারী যখন সংসার গুটিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দিকে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, পাশের বসতঘরের বাসিন্দা দলিলুর রহমান ও মোনাহার আলী তখন নৌকায় গবাদিপশু তোলা নিয়ে ব্যস্ত। দলিলুর রহমান বলেন, এই চরে নয়টি পরিবারের বাস। আট দিন থেকে বন্যায় ভাসছেন। খাবার পানি নেই, রান্না বন্ধ। শেষে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে চাড়ালকান্দি ঘাটে গিয়ে উঠেছেন।

চরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘হামাকরে বসতঘর আচিলো কাশিরপাড়া চরোত। বছরখানেক আগে কাশিরপাড়া চর যমুনা গিলে খায়। সগলি ছন্নছাড়া। ৯-১০ পরিবার খাটিয়ামারি চরোত আসে পরের জায়গাত আসে ঘর তুলে বসবাস করিচ্চি না। সেই ঘরও যমুনার ঢলে ভাসে লিয়ে যাচ্চে।’

খাটিয়ামারি চরের চেয়েও শোচনীয় অবস্থা চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের হাটবাড়ি ও দলিকার চরের। এই দুই চর এখন বানের পানিতে ভাসছে। অধিকাংশ বসতঘরে বুকসমান পানি। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নৌকায়, টিনের চাল আর বাঁশের উঁচু মাচায়। চরের কোথাও শুকনা জায়গা নেই।

আরও পড়ুন

হাটবাড়ি চরের বাসিন্দা আবদুল মোমিন বলেন, ‘ঘরের ভিতরে বাঁশের মাচা তুলে বউ-ছল লিয়ে রাত কাটাচ্চি। একরত্তি শুকনা জায়গা নাই। চুলা জলিচ্চে না। ঘরত চাল-ডাল থাকলেও রান্নার অভাবে অনাহারে দিন কাটিচ্চে।’

চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, যমুনার ঢলে এই ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি চর প্লাবিত হয়েছে। দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অনেকেই বসতঘর ভেঙে নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। সেখানে পর্যাপ্ত নলকূপ ও শৌচাগারের অভাব রয়েছে। এই ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত এক ছটাক চাল কিংবা এক টাকাও ত্রাণ বরাদ্দ মেলেনি। এই মুহূর্তে প্রয়োজন শুকনা খাবারের প্যাকেট।