যে বাড়িতে বাস ৮ হাজার মানুষের

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের মেহারণ গ্রামের ‘দালাল বাড়ি’ ৪০০ বছরের পুরোনো ।

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মেহারণ গ্রামের একটি বাড়ির নাম ‘দালাল বাড়ি’। বাড়িটিতে বসতঘর এক হাজারের বেশি, যাতে বাস সাড়ে ৮০০ পরিবারের প্রায় ৮ হাজার মানুষের। লোকজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, নানা জনশ্রুতি, লোকসংখ্যা, আয়তনসহ নানা ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কারণে জেলার মানুষে বাড়িটিকে একনামে চেনে।

প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রায় আধা কিলোমিটার প্রস্থের দালাল বাড়ি নিয়েই একটি গ্রাম। একটি ওয়ার্ড। সেই অর্থে এটি না বাড়ি, না গ্রাম, না ওয়ার্ড। উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রের তথ্য, এই বাড়িতে ভোটার আছেন আড়াই হাজারের বেশি। প্রতিবার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে এই বাড়ির ভোটারদের ভোটে একজন ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন।

লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই বাড়িতে সাধারণত চোর ঢোকে না। গাদাগাদি ঘর ও বাড়ির ভেতরকার একই রকম সরু পথের কারণে চোর ঢুকলেও বের হওয়ার পথ পায় না। হাজার মানুষের যূথবদ্ধ সামাজিক অবস্থান ও শান্তিপূর্ণ যাপিত জীবনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ৪০০ বছরের পুরোনো ওই বাড়ি।

সম্প্রতি দালাল বাড়ির ভেতর ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ঘরের পর ঘর। ঘরের যেন শেষ নেই। এক ঘরের ভেতর দিয়েই আরেক ঘরে যাওয়ার সরু পথ। অধিকাংশ ঘরই টিনের, আকারে ছোট। কিছু ঘর পাকা। আধা পাকা ঘরও আছে। বাড়ির অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের। তবে অবস্থাসম্পন্ন ঘরও কম নয়। ধনী-গরিবের এক অনন্য সহাবস্থানের চিত্র পাওয়া যায় এখানে। বাড়ির এক পাশে শত শত বছরের পুরোনো বোয়ালজুড়ি খাল। অন্য পাশে প্রাচীন দর্শনীয় জগন্নাথমন্দির।

কেন এটা ‘দালাল বাড়ি’

উপজেলা প্রশাসন সম্পাদিত মতলবের ইতিবৃত্ত নামের স্থানীয় ইতিহাসগ্রন্থের ২৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘৪০০ বছর আগে উপজেলার কাশিমপুর এলাকার জমিদার ও কুমিল্লার গৌরীপুর এলাকার জমিদারের মধ্যে বিবাদ থেকে রণক্ষেত্র (মহারণ) তৈরি হয়। মহারণ থেকেই মেহারণ নামের উৎপত্তি। সে সময় কুমিল্লার লাকসামের জমিদার এসে এই উপজেলার আলীয়ারা গ্রামে বসে খাজনা আদায় করতেন। দূরের জমিদার বলে চাষিরা খাজনা দিতে চাইতেন না। তখন লাকসামের জমিদার কালীবাবু মেহারণ গ্রামের জমিদার দ্বারিকানাথ দাস ও বৈকুণ্ঠ দাসকে খাজনা তোলার দায়িত্ব দেন। এর পর থেকে মেহারণের জমিদাররা আলীয়ারা ও নারায়ণপুর গ্রামের খাজনা ওঠাতেন। এর ভাগ লাকসামের জমিদারকেও দিতেন। জমিদার দ্বারিকানাথ দাস, বৈকুণ্ঠ দাস ও গিরিশচন্দ্র দাস যখন খাজনা আদায় করতেন, তখন স্থানীয় লোকজন তাঁদের “দালাল” বলে ডাকতেন। সে থেকে মেহারণের জমিদারদের নামের সঙ্গে “দালাল” তকমাটি যুক্ত হয়। বর্তমানে মেহারণবাসীর অনেকেই সেই জমিদারদের বংশধর। সমস্ত গ্রামটি অখণ্ড বাড়ি।’

বাড়িটির প্রবীণ বাসিন্দা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নগেন্দ্র চন্দ্র দাস (৭৬) বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ও ভারত থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন এই বাড়িতে বসতি গাড়েন। বাড়ির লোকজন নিজেদের মধ্যেই তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়দের বিয়ে দিতেন, এখনো দেন। এভাবে বাড়তে বাড়তে এই বাড়ির লোকসংখ্যা এখন প্রায় ৮ হাজার। তাদের ৮০ শতাংশই মৎস্যজীবী। নিজ এলাকা, ঢাকা ও কুমিল্লার দাউদকান্দিতে মাছের ব্যবসা করছেন অনেকে। বাড়িটির কিছু লোক চাকরিজীবী। বিদেশেও থাকেন কেউ কেউ। এ ছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন অন্য পেশাতেও।

ক্ষুদিরাম দাস (৮৫) নামের এক বাসিন্দা বলেন, পাশের জগন্নাথমন্দিরের আধিপত্য নিয়ে ৪০ বছর ধরে অতীন্দ্র দাস ওরফে সাধু বাবা ও ইউপি সদস্য উত্তম কুমার দাসের মধ্যে একটা বিবাদ চলছিল। কয়েক বছর আগে সেটি মিটে গেছে। এখন সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

ওই বাড়ির বাসিন্দা ব্যবসায়ী মনকুমার দাস বলেন, ‘আমাগো বাড়িডার ভেতরে সুন্দরভাবে চলাচলের জন্য একটি রাস্তা থাওন দরকার। এহন আঁকাবাঁকা যে রাস্তা আছে, হেইডা দিয়া রাইতবিরাইতে চলাচল করা যায় না। বাড়ির লগের মেহারণ-কাজিয়ারা রাস্তাডার অবস্থাও খুব খারাপ। এইডার সংস্কার করা জরুরি। কেউই এগুলার দিকে তেমন নজর দিতাছে না। এ ছাড়া এত বড় বাড়িডার আশপাশে কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নাই। কেউ অসুস্থ অইলে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়া চিকিৎসা করাইতে অয়। এতে ভোগান্তি ও যাতায়াত খরচও কম অয় না।’

বাড়ির বাসিন্দা ও নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য উত্তম কুমার দাস বলেন, এই বাড়ির বাসিন্দাদের অধিকাংশই গরিব। তারা পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা পায় না। এখানে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট আছে। আর্থিক সমস্যায় অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব সমস্যার কথা ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

দালাল বাড়ির বিষয়ে উপজেলার মতলব সরকারি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক হাকিকা আক্তার বলেন, আজকাল যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পৈতৃক বাড়ি থেকে সরে আলাদা বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে। এমন প্রেক্ষাপটে
এত বড় একটি বাড়ির অবস্থান এবং সেখানে হাজারো মানুষের যূথবদ্ধ বসবাস নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ও চমকজাগানো খবর। একটি বাড়ির গণ্ডিতে প্রায় আট হাজার লোকের শান্তিপূর্ণ বাস সারা দেশ, এমনকি সারা বিশ্বেই ব্যতিক্রমী ঘটনা।

মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা হক বলেন, তিনি উপজেলার দালাল বাড়ি সম্পর্কে জেনেছেন। একটি বাড়িতে একসঙ্গে এত লোকের বাস, অন্য রকম ব্যাপার। বাড়িটি যূথবদ্ধ সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল উদাহরণ।