যে সরকারি কলেজে গণিত পড়ানো হয় না

গণিতসহ চারটি বিষয়ের শিক্ষক নেই। পড়ানো হয় না বলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণিত নেয় না।

খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজছবি: প্রথম আলো

প্রতিষ্ঠার পর দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও গণিত বিষয়ের কোনো শিক্ষক যোগ দেননি খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পদায়ন না করায় কলেজের গণিত শিক্ষকের পদ শূন্যই রয়ে গেছে। ফলে কলেজে গণিত পড়ানোই হয় না। এ কারণে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণিত নেয় না।

গণিত এমন বিষয়, যা অন্য বিভাগের কেউ পড়াতে পারেন না। শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নজর দেওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্রনাথ

কেবল গণিত বিভাগ নয়, খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, পরিসংখ্যান এবং ইতিহাস বিষয়েরও কোনো শিক্ষক নেই। তবে অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে ওই সব বিষয়ে পাঠদান করালেও গণিত কেউ পড়ান না। শিক্ষকসংকটের প্রভাব পড়ছে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে। ২০১৮ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৪ শতাংশ। এই হার কমে ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশে।

কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন ছাত্রী জানায়, তারা গণিত বিষয়ে আগ্রহী হলেও ক্লাস না হওয়ায় আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখেনি। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে তাদের নিতে হয় জীববিজ্ঞান। চতুর্থ বিষয় (ঐচ্ছিক) হিসেবে নিতে হয় উচ্চতর গণিত। পরিসংখ্যান নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তা কেউ নেয় না। তবে চতুর্থ বিষয় হিসেবে কৃষিশিক্ষা, ভূগোল, মনোবিজ্ঞান ও মৃত্তিকাবিজ্ঞান নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব বিষয় নেওয়ার সুযোগ তাদের কলেজে নেই।

বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘গণিত বিষয়ে পাঠদান কখনো হয়নি। বাইরের শিক্ষকের কাছে গণিত পড়ছি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। ফলে বাইরের শিক্ষকের কাছে পড়ার সামর্থ্য অনেকেরই নেই।

শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় একমাত্র মহিলা কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০৯ সালে এটি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে এই কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ২০০। আবাসিক সুবিধা থাকায় খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলার পাশাপাশি পাশের রাঙামাটি জেলার মেয়েরাও পড়াশোনা করছেন কলেজটিতে।

গণিত বিষয়ে পাঠদান কখনো হয়নি। বাইরের শিক্ষকের কাছে গণিত পড়ছি
বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার

তবে শুরু থেকেই এই কলেজে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য ১৮ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ১৪ জন। গণিতসহ চারটি বিষয়ে শিক্ষক নেই। পদার্থবিজ্ঞান ও পৌরনীতির দুই শিক্ষক রয়েছেন প্রশিক্ষণে। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রয়েছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। শিক্ষকস্বল্পতা থাকায় তিন বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অনুমোদন মেলেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ কারণে জেলার নারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহ আলমগীর বলেন, শূন্য পদ পূরণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। জেলার একমাত্র সরকারি মহিলা কলেজ হওয়ার পরেও চরম অবহেলার শিকার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এখানকার শিক্ষার্থীরা গণিত না পড়েই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করছে উল্লেখ করে শাহ আলমগীর বলেন, চতুর্থ বিষয় হিসেবে গণিত নিলেও কেউ এতে গুরুত্ব দেয় না। বাইরে পড়াশোনা করে হাতে গোনা কয়েকজন পাস করে।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্রনাথ প্রথম আলোকে বলেন, গণিত এমন বিষয়, যা অন্য বিভাগের কেউ পড়াতে পারেন না। শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নজর দেওয়া উচিত।

কলেজ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গণিত শিক্ষক না থাকায় কলেজে তিনটি বিভাগের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। এই কলেজে একাদশ শ্রেণিতে মানবিকে ৪৪০ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ৬৬ জন ও বিজ্ঞান বিভাগে ৪০ জন ছাত্রী রয়েছেন। ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন ৬১০ পরীক্ষার্থী।

এইচএসসি পরীক্ষায় কলেজে বিভাগভিত্তিক পাসের হারে সব সময় পিছিয়ে থাকে বিজ্ঞান বিভাগ। ২০১৮ সালে মানবিক বিভাগে যেখানে পাসের হার ছিল ৬১ শতাংশ, সেখানে বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে এ হার ছিল ৪৭ শতাংশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালেও বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ছিল মাত্র ৩২ শতাংশ।

খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মধু মঙ্গল চাকমা বলেন, পাহাড়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে নজর দেওয়া উচিত। মান উন্নয়ন করতে গেলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। কিন্তু জেলার একমাত্র মহিলা কলেজে গণিত বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষক না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। তাই জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করা দরকার।