রংপুরে চাষিদের পেছনে ছুটেও আলু পাচ্ছে না হিমাগার কর্তৃপক্ষ

আলু তুলে খেত থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষকেরা। আজ রোববার রংপুরের তারাগঞ্জের ইকরচালি ইউনিয়নের মেনানগর দোলাপাড়া মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবছর সংরক্ষণের জন্য আলু রাখতে চাষিরা ধরনা দিতেন হিমাগারে। কিন্তু এবার হিমাগার কর্তৃপক্ষ মাইকিং করে সুবিধা দেওয়ার কথা বলেও চাষিদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না। এ অবস্থায় আলুর অভাবে হিমাগারগুলোর অনেকাংশ খালি পড়ে থাকার আশঙ্কায় হিমাগারমালিকেরা। রংপুরের বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার ছয়টি হিমাগারে খোঁজ নিয়ে ওই চিত্র পাওয়া গেছে।

কৃষকেরা বলছেন, গত মৌসুমে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে অনেক কৃষককে লোকসান গুনতে হয়েছে। তার ওপর এবার হিমাগারের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে খেত থেকে আলু বিক্রি করে চাষিরা লাভ পাওয়ায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণে অনীহা দেখাচ্ছেন। তবে চলতি মৌসুমে ওই দুই উপজেলায় আলুর আবাদও কমেছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে বদরগঞ্জে ৩ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছিল। এবার চাষ হয়েছে ২ হাজার ৬৭৫ হেক্টরে। তারাগঞ্জে গত মৌসুমে ৩ হাজার ৩২০ এবং এবার ৩ হাজার ১০৫ হেক্টরে আলুর চাষ হয়েছে। দুই উপজেলায় গত মৌসুমের চেয়ে এবার আলুর আবাদ কমেছে ৭৮৫ হেক্টরে। উপজেলা দুটিতে হিমাগার রয়েছে ছয়টি। ধারণক্ষমতা ৮ লাখ ৪৫ হাজার বস্তা।

দুই উপজেলার অন্তত ৮ জন ব্যবসায়ী ও ১৫ জন আলুচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে খেত থেকে উফশী জাতের আলু প্রতি কেজি গড়ে ১২ টাকায় ও স্থানীয় জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ২০-২২ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়েও চাষিরা মুনাফা পাচ্ছেন। ঝুটঝামেলা এড়াতে খেত থেকে তাঁরা আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

গত মৌসুমে আলু হিমাগারে রেখে লোকসান গুনেছেন তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামের আলুচাষি আজহারুল ইসলাম। এবার আলু তুলে খেত থেকেই তিনি বিক্রি করে দিচ্ছেন। জানতে চাইলে আজহারুল বলেন, ‘হামাক কি পাগলা পাইছেন! গতবার আলু তুলিয়া স্টোরোত (হিমাগারে) থুইয়া ভাড়ার টাকাও ওঠে নাই। এবার ভুঁইয়ের আলু ভুঁইয়োতে বেচাওচি। খরচ বাদে মণে (৪০ কেজি) লাভ হওচে ৮০ থাকি ৯০ টাকা। মুই বাঁচি থাকতে স্টোরোত আলু থুবার নেও।’

ওই উপজেলার ফকিরপাড়া গ্রামের চাষি তারাজুল ইসলাম বলেন, হিমাগারে গতবার ৭০-৭৫ কেজির বস্তার ভাড়া দিতে হয়েছে ২৪০ টাকা। এবার ৫০ কেজির বস্তার ভাড়ায় নেওয়া হচ্ছে ২৬০ টাকা। তাই তিনি হিমাগারে না রেখে জমি থেকেই ১৬৫ বস্তা আলু বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকা লাভ পেয়েছেন।

বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি গ্রামের চাষি শাহাজাহান আলী বলেন, ‘স্টোরোত নিগাইলে ভ্যান ভাড়া বস্তা লেবার আর স্টোর ভাড়া দিবার নাগে। হিসাব করি দেখছি স্টোরোত আলু থুবার গেইলে কেজিতে ৬ টাকা খরচ বেশি পড়ে। ঝামলা হয়। তার চাইতে ভুঁইয়োতে (জমিতে) ১২ টাকা কেজি ব্যাচেয়া লাভ পাচি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদরগঞ্জ উপজেলার তিন হিমাগারের সংরক্ষণ ক্ষমতা ৫ লাখ ২০ হাজার বস্তা। শনিবার পর্যন্ত সেখানে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ বস্তা।
শাহজালাল হিমাগারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান হাবীব বলেন, গত মৌসুমে এই সময় পর্যন্ত তিন হিমাগারে চাষিরা আলু রেখেছিলেন প্রায় চার লাখ বস্তা। অনুরোধ করার পরও চাষিরা এবারে আলু রাখতে হিমাগারে আসছেন না। এ কারণে আলুর অভাবে হিমাগারের অনেক অংশ এবার খালি পড়ে থাকবে।

হিমাগার–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার হিমাগারে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণ ভাড়া ২৬০ টাকা। সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, ৫০ কেজির বেশি ওজনের বস্তা হিমাগারে রাখা যাবে না। গত বছর ৭০-৭৫ কেজি পর্যন্ত প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া ছিল ২৪০ টাকা। গত মৌসুমে হিমাগারে আলু রেখে চাষি ও ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনেছেন। এ কারণে অনেকে এবারে আলুর আবাদ করেনি।

তারাগঞ্জের এনএন হিমাগারের ব্যবস্থাপক ডালিম মিয়া বলেন, ‘উপজেলার তিন হিমাগারে আলু রাখার ধারণক্ষমতা ৩ লাখ ২৫ হাজার বস্তা। শনিবার পর্যন্ত হিমাগারে আলু ঢুকেছে ১ লাখ ৮৮ হাজার বস্তা। গত বছর এই সময় পর্যন্ত আলু ছিল প্রায় তিন লাখ বস্তা। এবারে আলুর সরবরাহ কম পাওয়ায় আমরা এলাকায় মাইকিং করে চাষিদের বলছি হিমাগারে আলু রাখামাত্রই বস্তাপ্রতি ঋণ দেওয়া হবে। তবু তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।’

বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা কনক চন্দ্র রায় বলেন, গত বছর আলুতে লোকসান হওয়ায় চাষিরা অনেকে জমিতে শর্ষে ও ভুট্টা লাগিয়েছেন। এ কারণে আলুর আবাদ কমে যাওয়ায় এবং দাম ভালো পেয়ে জমিতে থেকে বিক্রি করায় হিমাগারে আলুর সরবরাহ কমেছে।