রাখাইন রাজ্য ছাড়ছেন হিন্দুরাও

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন। ছবিটি আজ তোলা। ছবি: প্রথম আলো
রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন। ছবিটি আজ তোলা। ছবি: প্রথম আলো

রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশাপাশি এবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ছাড়ছেন সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও। গত কয়েক দিনে রাখাইন রাজ্যে ফকিরাবাজারে বসবাসকারী ৭৫টি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৮৬ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রাখাইন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে আসা ৪১২ জন হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশু কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম হিন্দুপাড়ার একটি মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা সবাই রাখাইনের মংডুর ফকিরাবাজার গ্রামের বাসিন্দা। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছেন আরও দুই শতাধিক হিন্দু। তাঁরাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে পশ্চিম হিন্দুপাড়ার ওই মুরগির খামারে গিয়ে দেখা গেছে, চার শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু গাদাগাদি করে মেঝেতে পড়ে আছেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা মিয়ানমার থেকে আসা হিন্দুদের এ খামারে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
পালিয়ে আসা হিন্দুরা জানান, রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশপাশের গ্রাম চিকনছড়ি, ফকিরাবাজারসহ কয়েকটি গ্রামে হিন্দুরা বসবাস করেন। তাঁদের পেশা স্বর্ণালংকার তৈরি ও মাটি দিয়ে বাসনকোসন তৈরির কাজ করেন। অনেকে নদীতে মাছ আহরণ ও চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে মুখোশধারী কিছু সশস্ত্র লোক তাঁদের গ্রামে হামলা করছে। আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গুলিতে অনেকে হতাহত হচ্ছে। নারী-শিশুদের অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। প্রাণভয়ে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়, ধানখেতে ও বনজঙ্গলে লুকিয়ে আছেন। কিছু হিন্দু পরিবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু বাধা ও ভয়ের কারণে অনেকে ঢুকতে পারছেন না।
স্থানীয় হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও পশ্চিম হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা স্বপন শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে ১৬ জন হিন্দু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এ গ্রামে আশ্রয় নেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পালিয়ে আসেন আরও ৩৯৬ জন হিন্দু। মোট ৪১২ জনকে তাঁদের গ্রামের পাশে একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে রাখা হয়েছে। দুপুরে কক্সবাজার জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কয়েকজন নেতা খামারে এসে আশ্রিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন।

রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের কোয়াছং হিন্দুপাড়া থেকে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে আসা স্বর্ণকার দীজেন্দ্র শর্মা বলেন, গত ছয়-সাত দিনে ফকিরাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও আগুনে পুড়ে ৮৬ জন হিন্দুর মৃত্যু হয়েছে।
ফকিরা বাজার থেকে পালিয়ে আসা মিলন মল্লিক বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের (হিন্দুদের) কোনো বিরোধ নেই। অতীতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামাও হয়নি। গত বছরের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে তিনটি সীমান্তচৌকিতে হামলার পর টানা তিন মাস রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায় সেনা ও পুলিশ। এ সময় কয়েক শ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। ধর্ষণের শিকার হন বহু রোহিঙ্গা নারী। এ সময় ৯০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য ত্যাগ করে বাংলাদেশ আশ্রয় নিলেও তখন কোনো হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করেনি। কিন্তু এবার একযোগে সীমান্তচৌকিতে হামলার জন্য হিন্দুদেরও সন্দেহ করছে মিয়ানমার। তাই এত অত্যাচার-নির্যাতন। উদ্দেশ্য রাখাইন রাজ্য ত্যাগ করা।
মুরগির খামে আশ্রিত হিন্দুদের মিয়ানমারের নাগরিক দাবি করে কক্সবাজার জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রিয়োতষ শর্মা চন্দন, সহসাধারণ সম্পাদক চঞ্চল দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিন্দুরাও রাখাইন রাজ্যে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঘরবাড়ি হারিয়ে পালিয়ে আসা হিন্দুরা থাকা ও খাওয়া নিয়ে চরম কষ্টে আছেন। তাঁরা আশ্রিত হিন্দুদের তাৎক্ষণিকভাবে ২৫ হাজার নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছেন।
মংডুর চিকনছড়ির কুলালপাড়া থেকে পালিয়ে আসা বকুল বালা (৪৫) বলেন, গত বুধবার রাতে মুখোশধারী কিছু সশস্ত্র লোক তাঁর বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁর স্বামী কালু রুদ্র, মেয়ে সন্ধ্যাবালা ও নাতি বাপ্পুকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানতে পারেন তিনি। ওই রাতে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। তাঁর দাবি, যারা হামলা চালিয়েছে, তারা বৌদ্ধ ভাষায় কথা বলেছে। তবে তারা সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কি না জানা নেই। একই এলাকার বিজয় রাম পাল (৩৬) বলেন, তিনি মংডুর চিকনছড়ি গ্রামে হাল চাষ করতেন। ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২০টির বেশি সীমান্তচৌকিতে একযোগে সন্ত্রাসী হামলার পর হিন্দুদের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের মতো আচরণ করতে শুরু করে সে দেশের সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। রোহিঙ্গাদের মতো হিন্দুদের ঘরবাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। রাম পাল বলেন, ‘বলা হচ্ছে, হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি। অথচ আমরা জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক।’
কক্সবাজার জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, রাখাইন রাজ্যে এখন হিন্দুরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দরকার।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ৪১২ হিন্দুর বেশির ভাগই নারী-শিশু। রাতের বেলায় তাঁদের পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে থাকার জায়গা নেই বলে হিন্দুদের এই খামারেই কিছুদিন থাকতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন খামারে আশ্রিত হিন্দুদের বিস্কুট বিতরণ করেছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাঈন উদ্দীন বলেন, হিন্দুপাড়ায় আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের হিন্দু পরিবারগুলোর নিরাপত্তাসহ খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।