রাত নামলেই গ্রামে গ্রামে ধান সেদ্ধ করার ধুম

প্রকৃতিতে চলছে পৌষ মাস। গ্রামজুড়ে ধান কাটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন ঘরে ঘরে চলছে ধান সেদ্ধ করার উৎসব।

খেত থেকে তুলে আনা ধান সেদ্ধ করতে গ্রামে এমন উৎসবমুখর ভোররাত কাটছে পরিবারের নারী সদস্যদের। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে
প্রথম আলো

প্রকৃতিতে চলছে পৌষ মাস। গ্রামজুড়ে ধান কাটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন ঘরে ঘরে চলছে ধান সেদ্ধ করার উৎসব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজটি গ্রামের গৃহবধূরাই করেন। গাজীপুরের শ্রীপুরের কিছু গ্রামে ধান সেদ্ধ করার এমন উৎসবমুখর ভোররাত কাটছে এখন।

শ্রীপুরের সবুজে ঘেরা ও কৃষি উৎপাদনমুখী গ্রাম বাঁশবাড়ি, বারতোপা, চকপাড়া, মাওনা, শ্রীপুর, বরমী, লোহাগাছ, ভিটিপাড়া, কাওরাইদ, গাড়ারন, রাজাবাড়ীসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষক ও গৃহবধূদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, এসব গ্রামে বিঘার পর বিঘা জমিতে ধান আবাদ হয়। অগ্রহায়ণে চিরাচরিত নিয়মে এই গ্রামগুলোতে ধান কাটার পুরো প্রক্রিয়াটা উৎসবমুখর হয়ে থাকে। বিশেষ করে মাঠ থেকে ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে এলে সেই ধান বাড়ির নারীরা ভোররাতের দিকে মাটির চুলায় সেদ্ধ করেন। অনেকেই সন্ধ্যারাত বা মধ্যরাতেও ধান সেদ্ধ করেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোররাতের দিকেই ধান সেদ্ধ করার আয়োজন চলে। পরদিন ধান সেদ্ধ করা হবে, এ কথা মাথায় রেখে আগের দিন রাতে একটু আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েন গৃহবধূরা। আবছা অন্ধকার ভোররাতে এমন ধানসেদ্ধ কর্মযজ্ঞটি খুব আনন্দময় হয়। শীতের রাতে আগুন পোহানোর জন্য অনেক সময় শিশুরাও চুলার আশপাশে জড়ো হয়। ছেলে-বুড়োদের আলাপের আড্ডা জমে ধান সেদ্ধকে উপলক্ষ করে। ভোরের আলো ফোটার পর সেদ্ধ করা ধান রোদে শুকাতে দেওয়া হয়।

এবার তাঁরা প্রায় সারা রাত ধরে ধান সেদ্ধ করেছেন। রোদ ওঠার আগপর্যন্ত ধানগুলো ধানের নাড়া বা বড় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখে দেওয়া হয়। এই কাজগুলোতে যথেষ্ট পরিশ্রম থাকলেও বেশ আনন্দের।
রাবেয়া খাতুন, রাজাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা

শ্রীপুরের গাড়ারন গ্রামের তামান্না আক্তার বলেন, ভোররাতে ধান সেদ্ধ করার সময় পাশাপাশি কয়েকটি চুলা বসানো হয়। এ সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ধান সেদ্ধ করার কাজ চলে। নীরব-নিস্তব্ধ ভোরে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় খুব ভালো সময় কাটে গৃহবধূদের। এরপর রোদ উঠলে সেই ধান নিয়ে সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে যান। তবে ধান সেদ্ধ করার সময়টুকু যুগের পর যুগ গ্রামে একটা উৎসবের মতো আমেজ সৃষ্টি করছে।

রাজাবাড়ী এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, এবার তাঁরা প্রায় সারা রাত ধরে ধান সেদ্ধ করেছেন। রোদ ওঠার আগপর্যন্ত ধানগুলো ধানের নাড়া বা বড় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখে দেওয়া হয়। এই কাজগুলোতে যথেষ্ট পরিশ্রম থাকলেও বেশ আনন্দের।

১১ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে বাঁশবাড়ি গ্রামের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় সড়কের পাশে চুলায় ধান সেদ্ধ করতে দেখা গেছে আছিয়া বেগমকে। সেখানে চুলার পাশে জড়ো হয়েছিলেন তাঁর পরিবারের আরও কয়েক সদস্য। আলাপচারিতার মধ্য দিয়েই ধানসেদ্ধ চলছিল। আছিয়া বলেন, ‘পুরুষেরা ধান কেটে নিয়ে আসেন। আমরা সেদ্ধ করি, রোদে শুকাই। সবাই মিলে আনন্দের সঙ্গেই কাজগুলো করি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ এস এম মূয়ীদুল হাসান বলেন, ‘অগ্রহায়ণ-পৌষের এই সময়টুকু গ্রামজুড়ে আনন্দের আবেশ ছড়ায়। গ্রামের নারী-পুরুষ মিলে ধান তোলা, সেদ্ধ করায় অংশ নেন। এই কর্মযজ্ঞ আনন্দময় হয়ে এখনো টিকে আছে। ধান মাড়াই থেকে সেদ্ধ করা, রোদে শুকানোর কাজগুলো চলছে উৎসবমুখর পরিবেশে। একবার খুব উৎসবমুখর পরিবেশে নবান্ন উৎসব করেছিলাম। আবার এমন আয়োজন করার ইচ্ছা আছে।’