রিকশা ফেরত পাওয়ার আশায় আনিস শেখরা...
বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বাংলা নববর্ষের দিন। একই সঙ্গে প্রথম রোজা। সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ চলছে। কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে ফুটপাতে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন আনিস শেখ। তাঁর পাশে বসা ওবায়দুল শেখেরও একই অবস্থা।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আনিস ও ওবায়দুলের দুটি রিকশা শহরের থানা মোড় এলাকা থেকে জব্দ করে পুলিশ। এ রকম অন্তত ৩৫টি ব্যাটারিচালিত রিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ও ভ্যান জব্দ করে মডেল থানার ভেতরে নেওয়া হয়। তাঁদের অপরাধ, কঠোর লকডাউনে তাঁরা আইন ভঙ্গ করেছেন।
আনিস ও ওবায়দুল দুজনই বলছিলেন, পুলিশ আশ্বাস দিয়েছিল, আসরের নামাজের পর ছেড়ে দেবে। কিন্তু কেন জানি পুলিশ আর ছাড়ছে না। থানা-পুলিশের এক কর্মকর্তা তাঁদের জানিয়েছেন, ‘বড় স্যারের অনুমতি না মেলায় ছাড়া হচ্ছে না, সন্ধ্যার পর ব্যবস্থা হতে পারে।’
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁদের রিকশাগুলো ছাড়া হয়নি। রিকশাচালকেরা থানার আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন নিজ নিজ রিকশা ফেরত পাওয়ার আশায়। উপার্জনের একমাত্র উপায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের চোখে-মুখে কেবল হতাশা আর বিষণ্নতা।
ফুটপাতে বসেই কথা হচ্ছিল আনিস ও ওবায়দুলের সঙ্গে। সদর উপজেলার খাজানগর এলাকার বাসিন্দা আনিস জানালেন, সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে আছে। সকাল নয়টায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন। ৯০ টাকা আয়ও হয়েছিল। সাড়ে ১১টার দিকে থানা মোড় থেকে পুলিশ তাঁর রিকশা জব্দ করে থানায় নেয়।
ওবায়দুল শেখ বললেন, তাঁর পরিবারে একমাত্র ছোট ভাই ও মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাড়িতে একটি গরুও পালন করেন তিনি। একই সময়ে তাঁরও রিকশা জব্দ করে থানায় নেয় পুলিশ। এর আগে মাত্র ৪০ টাকা আয় করেছেন। বাড়িতে ফোন করে জানান যে তাঁর রিকশা জব্দ হয়েছে।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে থানায় গিয়ে দেখা যায়, ৩০ থেকে ৩৫ জন রিকশাচালক গোলচত্বরে এদিক–সেদিক বসে আছেন। তাঁদের অনেকের বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছর। কেউ জানতে পারছেন না, ইফতারের আগে তাঁদের রিকশাগুলো ছাড়া হবে কি না।
থানার ভেতর থেকে ফিরে এলে কথা হয় আরেক রিকশাচালক মোহাম্মদ রাব্বীর সঙ্গে। তাঁর বাড়ি শহরের কালিশংকরপুর এলাকায়। রাব্বী বললেন, ছয় ঘণ্টা ধরে বসে আছেন। তাঁদের তো শাস্তি হয়েই গেছে। অপরাধ মেনেও নিয়েছেন। আজ প্রথম রোজা। যদি ইফতারের আগে ছেড়ে দিত, তাহলে মায়ের সঙ্গে ইফতার করতে পারতেন।
যখন রিকশা জব্দ করা হয়, তখন অনেক চার চাকার গাড়ি সামনে দিয়ে চলে গেছে। তাঁদের গাড়ি আটকানো হয়নি। গরিব বলে সব দোষ আমাদের।
মোহাম্মদ মুসা নামের এক অটোরিকশাচালক বলেন, ‘প্রথম রোজার দিন ঘরে থাকলে চলে না, তাই বের হয়েছিলাম। আইনের কথা শোনায় পুলিশ। দরিদ্র–অভাবী মানুষের কথা কেউ শোনে না।’
আবারও দেখা হলো ওবায়দুলের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘যখন রিকশা জব্দ করা হয়, তখন অনেক চার চাকার গাড়ি সামনে দিয়ে চলে গেছে। তাঁদের গাড়ি আটকানো হয়নি। গরিব বলে সব দোষ আমাদের।’
রিকশাচালকদের সঙ্গে কথার বলার সময় থানার ভেতর থেকে পরিচিত এক উপপরিদর্শক (এসআই) বের হলেন। সামনের দোকান থেকে ইফতারি কিনে বললেন, ‘ভাই, আমাদের কিছুই করার নেই। বড় স্যারের কোনো অনুমতি মেলেনি। তাই যানবাহনগুলো ছাড়া যাচ্ছে না। ইফতারের পর সিদ্ধান্ত এলে বলা যাবে।’
এরই মধ্যে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়টার কাছাকাছি। মসজিদের মাইক থেকে আজানের ধ্বনি ও সাইরেনের আওয়াজ। থানার ভেতরে গোলচত্বরে জড়ো হওয়া রিকশাচালকেরা পানি ও মুড়ি মুখে দিয়ে ইফতার করলেন। পরে অবশ্য থানার ভেতরের মসজিদ থেকে তাঁদের ইফতার দেওয়া হয়।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁদের রিকশাগুলো ছাড়া হয়নি। রিকশাচালকেরা থানার আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন নিজ নিজ রিকশা ফেরত পাওয়ার আশায়। উপার্জনের একমাত্র উপায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের চোখে-মুখে কেবল হতাশা আর বিষণ্নতা।
বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শওকত কবির বলেন, ‘সরকারের ঘোষিত লকডাউন আমরা কঠোরভাবে পালন করছি। লকডাউন অমান্য করে যাঁরা গতকাল রিকশা বের করেছেন, তাঁদের রিকশা জব্দ করা হয়েছে। আজও রিকশা জব্দ করা হচ্ছে।’ তবে এসব রিকশা কখন ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।