‘রোয়াইঙ্গা’ ভাষার স্বীকৃতি চায় রোহিঙ্গারা, কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে মানববন্ধন

মাতৃভাষার স্বীকৃতি চেয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন কর্মসূচি। কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গাশিবিরে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজেদের মাতৃভাষা ‘রোয়াইঙ্গা’ ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। আজ সোমবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ক্যাম্পে ছোট পরিসরে এ কর্মসূচির আয়োজন করেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সাড়ে চার বছরে এবারই প্রথম এই কর্মসূচির আয়োজন করলেন রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজার শহর থেকে ৭৬ কিলোমিটার দূরে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা রোহিঙ্গা (ক্যাম্প-২৪) আশ্রয়শিবির। আশ্রয়শিবিরের মধ্যভাগে এলএমএস ডি ব্লকে তাওহিদিয়া কাশেমুল উলুম মাদ্রাসা। বেলা ১১টার দিকে রোহিঙ্গা ন্যাশনাল এডুকেশন বোর্ডের ব্যানারে শতাধিক রোহিঙ্গা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সেখানে মানববন্ধন করেন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের তাঁরা স্মরণ করেন। পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা ‘রোয়াইঙ্গা’ ভাষার স্বীকৃতি দাবি করেন।

মানববন্ধনে বক্তব্য দেন মাদ্রাসাশিক্ষক হাফেজ সুলতান মাহমুদ, সৈয়দ নুর, রোহিঙ্গা ভাষাচর্চা নিয়ে কাজ করা মোহাম্মদ খালেদ ও শিক্ষক সৈয়দুল ইসলাম। শিক্ষক হাফেজ সুলতান আহমদ ও গবেষক মোহাম্মদ খালেদ বলেন, প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর একটি মাতৃভাষা রয়েছে। সেই মাতৃভাষা নিয়ে তারা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তাঁদেরও এখন নিজস্ব রোয়াইঙ্গা ভাষার বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ নেই। রোহিঙ্গা শিশুরা মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে চায়।

রোহিঙ্গা শিক্ষক সৈয়দ নুর বলেন, বাংলাদেশ তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) দেশ নয়, চিরস্থায়ী ঠিকানাও নয়। বাংলাদেশ মানবিক আশ্রয় দিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচিয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোয়াইঙ্গা ভাষার স্বীকৃতি দিলে এবং এই ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পেলে, রোহিঙ্গারাও মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে।

উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া, মধুরশিয়া আশ্রয়শিবিরেও প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গারা সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে।

রোহিঙ্গা শিক্ষক সৈয়দ নুর বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোয়াইঙ্গা ভাষার স্বীকৃতি দিলে এবং এই ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পেলে, রোহিঙ্গারাও মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের অধিকার রোহিঙ্গাদেরও আছে। তাঁরাও নিজের ভাষার স্বীকৃতি চাইছে। আশ্রয়শিবিরে যে পরিবেশে রোহিঙ্গারা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে, মিয়ানমারে সে সুযোগ ছিলই না।

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে মাতৃভাষার পাঠ নিচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা
ছবি: প্রথম আলো

আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুকিশোরদের পড়াশোনা ও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার জন্য মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যেন মর্যাদার সঙ্গে নিজভূমে (রাখাইন রাজ্যে) ফিরে যেতে পারেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারেন এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত কার্যকরে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, তিন দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের স্কুল-কলেজে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ বন্ধ রাখা হয়। ‘রোয়াইঙ্গা’ ভাষায় কিছু বই-পুস্তক থাকলেও সেগুলো গোপনে পড়াতে হয় সন্তানদের। শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১২ ভাগ শিশুর ভাগ্যে ভাষাচর্চার সুযোগ মেলে। কিন্তু বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর রোহিঙ্গা শিশুদের কপাল খুলে যায়। তারা আশ্রয়শিবিরে ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ ভাষার পাশাপাশি নিজেদের ‘রোয়াইঙ্গা’ ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।

কক্সবাজারের সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদানের শিক্ষাকেন্দ্র আছে ২ হাজার ৫০০টির বেশি। এসব কেন্দ্রে অন্তত ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকিশোর পড়ছে। দেশি-বিদেশি কিছু এনজিও কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করে। আশ্রয়শিবিরে মাদ্রাসা-মক্তব আছে আরও অন্তত ৩০০টি। সেখানেও ৩০-৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকিশোর ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি রোয়াইঙ্গা ভাষা রপ্ত করছে। কিন্তু কোনো কেন্দ্রে বাংলা পড়ানো হচ্ছে না, এ ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা আছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর অত্যাচার–নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসেন আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।