শত বাধা পেরিয়ে প্রত্যেকেই আজ স্বনির্ভর

তৃণমূল থেকে উঠে আসা লালমনিরহাটের সফল তিন সংগ্রামী নারীকে ব্র্যাকের উদ্যোগে নারী দিবসে সম্মাননা দেওয়া হয়। আজ মঙ্গলবার দুপুরে লালমনিরহাট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

হাসনা বেগম, হাসিনা বেগম ও সোহাগী বেগম। এই তিন নারীর বাড়িই লালমনিরহাট সদর উপজেলায়। তাঁদের আর্থিক অবস্থা ছিল করুণ। এর মধ্যে দুজন তালাকপ্রাপ্ত; অপরজন অতি রক্ষণশীল পরিবারের। তবে জীবনযুদ্ধে হেরে যাননি কেউই। শত বাধা পেরিয়ে প্রত্যেকেই আজ তাঁরা স্বনির্ভর। এই তিন নারী এখন অনেকের কাছে অনুকরণীয়ও।

লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ে ওয়ারলেস কলোনির এম এ হান্নান ও আনোয়ারা বেগম দম্পতির সন্তান হাসনা বেগম। বর্তমানে তিনি লালমনিরহাট শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকের ল্যাব টেকনোলজিস্ট হিসেবে চাকরি করছেন। বিয়ের পর থেকে স্বামীর পরিবার নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত হাসনাকে। যৌতুকের জন্য চাপ দিত। একপর্যায়ে হাসনা বেগম তাঁর বাবার বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হন। বিয়ের সাত বছরের মাথায় তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁর জীবনযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি।

হাসনা বেগম বলেন, ‘ব্র্যাক আমার বিপদের দিনে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। সে জন্য আমি স্বামীর পরিবারের নির্যাতনের কথা ভুলে গিয়ে এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আমি এখন একটি বেসরকারি ক্লিনিকের ল্যাব টেকনোলজিস্টের চাকরি করছি।’

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার সাহেরা বেগম ও হোসেন মিয়া দম্পতির সন্তান হাসিনা বেগম। তিনিও একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী। তাঁর সন্তান যখন চার মাসের গর্ভে, তখন তাঁকে ছেড়ে চলে যান তাঁর স্বামী। মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে ব্র্যাকের ইউপিজি প্রোগ্রামের সদস্য হন হাসিনা। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন। উন্নত পদ্ধতিতে গবাদিপশু লালন-পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। ২৪ শতক জমি ক্রয় করেছেন। মেয়ে রাশিদা খাতুন নবম শ্রেণির ছাত্রী। তাঁকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন হাসিনার। একজন হতদরিদ্র থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এই নারী এখন অনেকের কাছে প্রেরণার উৎস।

হাসিনা বলেন, ‘আমি ব্র্যাকের কর্মীদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় হারানো মনোবল ফিরে পেয়েছি। এখন আমি গবাদিপশু লালন-পালন করি, জমিও কিনেছি। আমার একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছি, সে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।’

লালমনিরহাট সদর উপজেলার হাড়িভাঙ্গা গ্রামের আবদুল বাতেন ও রহিমা বেগম দম্পতির সন্তান সোহাগী বেগম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। পারিবারিক কুসংস্কারের কারণে তাঁকে বাইরে গিয়ে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়। তিনি সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন। তবে আয় উপার্জন বেশি ছিল না, অর্থাভাব ও পুষ্টির অভাবে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে ব্র্যাকের সহযোগিতা নেন। ব্র্যাক সোহাগী বেগমকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়। বর্তমানে তিনি এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের সেবা করেন।

সোহাগী বলেন, ‘ব্র্যাকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়ে আমি এখন গর্ভবতী মায়েদের সেবা করি। আমাকে সবাই সম্মান করেন। আমি এতে ভীষণ খুশি।’

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে লালমনিরহাট জেলা পরিষদ মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে হাসনা, হাসিনা ও সোহাগীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর। তৃণমূল থেকে উঠে আসা সফল তিন সংগ্রামী নারীর প্রশংসা করেন তিনি। তাঁদের আজকের এ অবস্থানে আসতে ব্র্যাকের ইতিবাচক ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক।

লালমনিরহাট ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক আশরাফুল আলম বলেন, ‘অতিদরিদ্র ও সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নানান প্রতিকূলতার শিকার নারীদের সমাজে সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসনের জন্য ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। অতিদরিদ্র ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা হাসনা বেগম, হাসিনা বেগম ও সোহাগী বেগম ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টায় আমরা তাঁদের পাশে থেকে সহায়তা করেছি। তাঁরা সফলতা পেয়েছেন, তাই তাঁদের সম্মাননা জানানো হয়েছে, যাতে অন্যরা উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পান।’

লালমনিরহাট জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক রশিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান ও লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) মারুফা জামাল।