শয্যাশায়ী মায়ের অভিযোগ তদন্ত করতে বিচারক নিজেই গেলেন বাড়িতে

শয্যাশায়ী জাহানূর বেগম। বৃহস্পতিবার বিকেলে বরিশাল নগরের বৈদ্যপাড়া এলাকায় বড় ছেলের ভাড়াবাড়িতে
প্রথম আলো

জাহানূর বেগমের বয়স ৭৫ বছর। বয়স আর রোগ–শোকে শয্যাশায়ী তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর বড় ছেলের কাছেই আশ্রয় জুটেছে। বড় ছেলে কলেজের শিক্ষক। নিজের পরিবারের ভরণপোষণ, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার ব্যয় মিলিয়ে বড় ছেলের বেতনে যে কুলাচ্ছে না, মা টের পান। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত আরেক ছেলে ও মেয়ে তাঁর খোঁজ নেন না। এমনকি বাড়িতে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাবেন, তা–ও করতে দিচ্ছেন না ওই দুই ছেলে-মেয়ে। সংসারের টানাপোড়েন থেকে নিজের চিকিৎসা ব্যয়কে রেহাই দিতে অবশেষে ভরণপোষণ আইনে মামলা করেছেন জাহানূর বেগম।

আদালত সূত্র জানায়, হাঁটাচলা করতে না পারায় জাহানূর বেগম আজ বৃহস্পতিবার সকালে বড় ছেলেকে দিয়ে এই মামলার আবেদন পাঠান বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. কবির উদ্দীন প্রামাণিক আবেদনটি পাঠান অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহর আদালতে। এরপর বিচারক মাসুম বিল্লাহ মামলার আরজিটি গ্রহণ করে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজকে সঙ্গে নিয়ে নগরের বিএম কলেজ এলাকার বৈদ্যপাড়া এলাকার ভাড়া বাড়িতে যান। সেখানে বিচারক মাসুম বিল্লাহ শয্যাশায়ী জাহানূর বেগমের জবানবন্দি নেন।

স্বচ্ছল দুই ছেলে–মেয়ে মায়ের কোনো খোঁজখবর নেন না বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন জাহানূর বেগম। তার ওপর তাঁর অস্ত্রপচারের জরুরি প্রয়োজন, যার জন্য কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাবেন, তা–ও করতে দিচ্ছেন না ওই দুই ছেলে-মেয়ে।

এ সময় জাহানূর বেগম ভাঙা ভাঙা বাক্যে বলেন, ‘কী করলাম, আমি কী করলাম! গ্রামে আমার স্বামীর অনেক সম্পদ ছিল। বড় ছেলের ওপর বহু বছর পড়ে আছি। কয় টাকা বেতন পায়। ওর সংসার, আমার ওষুধপত্র কিনে ছেলেটা দম ফেলতে পারে না। মেজ ছেলে, এক মেয়ে কোনো খোঁজ নেয় না। জমি বিক্রি করে আমার চিকিৎসা করাব, তা-ও বিক্রি করতে দেয় না।’

জাহানূর বেগমের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায়। স্বামী সিরাজুল ইসলাম ২০১৪ আগে মারা গেছেন। চার ছেলে–মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে বড় এবং মেয়ে দুটি তাঁদের ছোট। মেজ ছেলে খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং তাঁর ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়েছে ভালো ঘরে। কিন্তু তাঁরা মায়ের কোনো খোঁজখবর নেন না বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন জাহানূর বেগম। তার ওপর তাঁর জরুরি অস্ত্রপচার প্রয়োজন, যার জন্য কয়েক লাখ টাকা লাগবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।

জাহানূর বেগমের জবানবন্দি গ্রহণের পর বিচারক মাসুম বিল্লাহ ঘটনার সত্যতা পেয়ে বিকেল চারটায় মামলাটি গ্রহণ করে মেজ ছেলে ও ছোট মেয়ের বিরুদ্ধে সমন জারি করছেন। আগামী ১ ডিসেম্বর তাঁদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। বিচারক নিজেই এই অভিযোগ তদন্ত করতে বাদীর বাড়িতে ছুটে গেছেন। আমরা গিয়ে যা দেখেছি, তা খুবই মর্মান্তিক। কোনো মা যেন জীবিত অবস্থায় অবহেলা-বঞ্চনার শিকার না হন। জাহানূর বেগম অনেক অসুস্থ। ভেঙে ভেঙে কথা বলেন। বলছিলেন, “বাবা, কতটা নিরুপায় হলে একজন মা সন্তানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দেয়।”’

প্রবেশন কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সঙ্গে পরামর্শ করে জাহানূর বেগমের চিকিৎসার জন্য সরকারের চিকিৎসা সহায়তা তহবিল থেকে আমরা তাঁকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’