শহর, নদ আর সুন্দরবনে বিস্তৃত মকবুলের জীবন

মকবুল হোসেন ভ্যানে ফল বিক্রি করেন। যে দিন তিনি ফল বিক্রি করতে যান না, সে দিন ফরেস্ট ঘাট আর জেলখানা ঘাটে মাছ ধরেন
ছবি: প্রথম আলো

অল্প অল্প করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে সকালের সূর্য। নরম রোদ আঁচল বিছিয়েছে ভৈরবের বুকে। জোয়ারের পানিতে নদীও একটু একটু করে ফুলে উঠছে। খুলনার ফরেস্ট ঘাটের কংক্রিটের পাকা পথ বেয়ে এক ব্যক্তি ভেজা শরীরে নদী থেকে উঠে আসছেন। পরনে লুঙ্গি, বোতাম খোলা হাফহাতা শার্ট। এক হাতে বিশেষ ধরনের তিন কোনা জাল, অন্য হাতে মাছের ব্যাগ। পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে রয়েছে ভেজা চুলে।

ফরেস্ট ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল মুছলেন। নিংড়ে নিলেন পরে থাকা লুঙ্গি। ছবি তুলতে চাইলে জানালেন, ‘হাতে বেশি সময় নেই, যা করার এক মিনিটের মধ্যে করতে হবে।’ এরপর ভীষণ ব্যস্ত পায়ে হাঁটা শুরু করলেন সামনের জেলখানা ঘাটের দিকে। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুয়েকটি কথা বলা গেল।

জোয়ার আসা শুরু হলে দ্রুতই নদী ভরে যায়। আর জোয়ারের পানি বেশি হয়ে গেলে তখন আর ঠিকমতো মাছ ধরা যায় না। ব্যস্ততার এ কারণ ব্যাখ্যা করলেন হাসিমুখে। জানালেন, কথা বলতে চাইলে জেলখানা ঘাটে আধা ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে। অবশ্য মিনিট পনেরো বাদে নদী থেকে উঠে এসে বললেন, ‘ফরেস্ট ঘাট আর জেলখানা ঘাট—এই দুই ঘাটে মাছ ধরি। জোয়ার লেগে গেছে আর হবে না।’

আজ সোমবার সকালে দ্বিতীয় দফার আলাপে জানা গেল, তাঁর নাম মকবুল সরদার। বয়স ৫৫। বাড়ি দক্ষিণের উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ভাগবা গ্রামে। অনেক ছোটবেলায় বাবা মারা যায় মকবুলের। বয়স যখন ১৩-১৪ বছর, তখন জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন শহরে। এখন থাকছেন কালীবাড়ি রোডের পানসি ঘাট মসজিদ এলাকায়।

মকবুল সরদার বলেন, ‘দ্যাশে অভাব ছিল। এলাকায় বাঁধ ভাইঙে গেছিল। ছোটকালে বাপ মারা গেলে পড়ালেখা হয়নি। জমিজমাও ছেল না। তারপর টাউনে চইলে আসি। টাউনে আয়ছি ৪০-৪২ বছর হইয়ে গেছে। টাউনে আইসে নানা কিছু করিছি। ইট–খোয়া ভাঙা, রিকশা চালানো, ভ্যান চালানো, দিনমজুরি—কোনোটা বাদ রাখিনি।’

এখন মকবুল ভ্যানে করে শহরে ফল বিক্রি করেন। যেদিন ব্যবসা করতে যান না, সেদিন নদীতে মাছ ধরতে আসেন। গ্রামের বাড়ি থেকে জাল আর বাঁশের চটা এনে নিজেই জাল তৈরি করেছেন। মাছও একেবারে খারাপ হয় না। নিজেদের খাওয়ার মতো মাছ রেখে বাকিটা বিক্রি করেন। মকবুল বলছিলেন, ‘তরমুজের সময় তরমুজ, লিচুর সময় লিচু, আমের সময় আম; যখন যে ফলের সিজন, সেই ফল বেচি। বড় বাজার থেকে ফল কিনি। আজকে ফল কিনতে পারিনি। যে লিচু ৭০০ টাকা, ৯০০ টাকা হাজার কিনি, আজ সেই লিচু ১ হাজার ৭০০/৮০০ টাকা হাজার চায়। ডবল দামে কিনে ব্যবসা হবে না। তাই অবসর টাইম কয়টা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’

একটু থেমে মকবুল বললেন, ‘যখন ব্যবসায় যাই না, তখন নদীতে আসি। এটা কিন্তু নেশাও। আসলে আমরা দক্ষিণের মানুষ। কাদা, পানি, বাদা, জাল, মাছ—এসব খুব আপন মনে হয়। আবার ধরেন, সম্পদ তো নেই। এই শরীরই হচ্ছে সম্পদ-জমিজমা। শরীরটা ভালো রাখতে এসব কাজ করার দরকার আছে।’

ফলের ব্যবসায় রোজগার কেমন হয়, জানতে চাইলে মকবুল বলেন, ‘ডেইলি ব্যবসা হয় না। লিচুর কয় দিন একটু ব্যবসা হবে। লিচুতে এক সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন এক-দেড় হাজার টাকা লাভ হয়েছে। লিচু শেষে তো প্রতিদিন আড়াই-তিন শ টাকার বেশি ব্যবসা হবে না। আবার এখন চালের দাম ৬০ টাকা। এক কেজি তরকারির দাম ৪০ টাকা। যাতে ছোঁবেন, তাতে দাম। সংসার চালানো এখন কঠিন হয়ে গেছে।’

কথায় কথায় জানা গেল, স্বামী-স্ত্রী মিলে শহরে থাকলেও চার ছেলে থাকে গ্রামে। বড় ছেলে বাগদার পোনার ব্যবসা করে সচ্ছল। অন্য তিনজন পড়াশোনার পাশাপাশি ইটভাটায় মৌসুমে প্রায় ছয় মাস কাজ করে। মকবুলও শহর থেকে টাকা পাঠান। মকবুলের জীবিকার ক্ষেত্র শুধু এই খুলনা শহর নয়, সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত। মকবুল মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে যান। বাড়িতে গিয়েও বসে থাকলে চলে না। জীবনের সঙ্গে আজন্মকালের যুদ্ধটা যেন থামানোর সুযোগ নেই। বাড়িতে গেলে নদী থেকে বাগদার পোনা আহরণ করেন। আবার মাঝেমধ্যে সুন্দরবনে গিয়ে মাছ ধরেন, কখনো গোলপাতা কাটার দলে কাজ করেন।
মকবুল বলেন, ‘আমাদের কষ্টের জীবন। যেখানে যাই, কষ্ট না করলি চলবে না। এখনো বাড়িতে গিয়ে বাগদা রেণু ধরি। আবার বাড়িতে দুই-আড়াই মাস যখন থাকি, তখন বাদা করতি যাই।’ মকবুলের কাছ থেকে জানা গেল, সুন্দরবনে গিয়ে মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা, গোলপাতা কাটা, মধু সংগ্রহ করার কাজকে স্থানীয় লোকজন বাদা করা বলে।

গ্রাম ভালো লাগলেও একেবারে গ্রামে থেকে যাওয়ার উপায় নেই মকবুলের। বাস্তবতা মেনে নিয়ে বললেন, ‘একদমই থাকতি ইচ্ছে করে না শহরে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। গ্রামে গিয়ে খাব কী? ইনকাম তো সব শহরে। তাই শহরেই থাইকে যাতি হবে। মাঝেমাঝে গ্রামে যাব। আবার শহরে আসতি হবে।’