শিক্ষককে আটকে রেখে খোঁজা হচ্ছিল জুতার মালা

নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ
ছবি: সংগৃহীত

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার ঘটনায় বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই কলেজের শিক্ষক আকতার হোসেনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আকতার হোসেন কলেজটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অধ্যক্ষকে অপদস্থ করার আগমুহূর্তে আকতার হোসেনের পাশে থাকা এক ব্যক্তি ‘জুতার মালা’ কোথায় জানতে চান। এ সময় আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এই মালা, মালাডা কই...?’ অন্য এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘এই শাহীনূর ভাই, মালাডা কোহানে?’ তখন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে কলেজ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এই মালা, মালাডা কই’ বলা কণ্ঠটি আকতার হোসেনের। অবশ্য আকতার হোসেন বিষয়টি অস্বীকার করে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওটা তাঁর কণ্ঠ নয়, অপর এক আওয়ামী লীগ নেতার কণ্ঠ।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ঘটনার সময় লাল টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা মধ্যবয়সী আকতার হোসেনের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গোটানো ছিল। পা ছিল খালি। ঘটনার আগমুহূর্তে কলেজ ভবনের কলাপসিবল গেটের সামনে তাঁকে হ্যান্ডমাইক নিয়ে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার সামনে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এরপর কলেজের অধ্যক্ষ ও একাদশ শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে হেলমেট পরিয়ে বের করে আনার কথা বলেন কেউ কেউ। তখন আকতার হোসেন বলছিলেন, ‘কিচ্ছু দরকার নেই, কিচ্ছু হবে না।’

পুরো ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা নড়াইলের সভাপতি ও নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মলয় কুমার নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজের ভেতরে অধ্যক্ষবিরোধী শক্তি, যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের ইন্ধনে অধ্যক্ষকে অপদস্থ করা হয়েছে বলে জোরালোভাবে কথা উঠেছে।’

এদিকে আকতার হোসেনের নাম ইন্ধনদাতা হিসেবে উঠে আসছে বলে জানিয়েছেন নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়ও। তিনি বলেন, ‘আমরা সবকিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। যারাই জড়িত থাক না কেন, সঠিকভাবে চিহ্নিত করে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

আকতার হোসেন বহিষ্কৃত

নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর ফারুকের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে আকতার হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি জানানো হয়। তাঁকে দেওয়া কারণ দর্শানোর চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের এক ছাত্রের মুঠোফোনে স্ট্যাটাস নিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আপনি ওই কলেজের একজন শিক্ষক। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে দেখা যায়, আপনার উপস্থিতিতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে বের করে আনা হয়, যা নিন্দনীয় ও শিক্ষকসমাজকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গণমাধ্যমের খবরে আপনাকে জড়িত করে সংবাদ হচ্ছে। সে কারণে আপনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। আমরা মনে করি, আপনি সভাপতি হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।’

জানতে চাইলে আকতার হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অব্যাহতিপত্র হাতে পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে নেমেছে।

এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী বলেন, আকতার হোসেনকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মশিয়ার রহমানকে বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ জুন ওই কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিজের ফেসবুকে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়। এ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজের শিক্ষক, ওই শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন সদস্যকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীকে তাঁদের কাছে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ সদস্যরা ওই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে যেতে চাইলে উত্তেজিত ছাত্র ও বহিরাগত কয়েকজন বাধা দেন। তখন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি জানানো হয়।

বিকেল চারটার দিকে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং ওই শিক্ষার্থীকে কলেজের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ থেকে বের করা হয়। নিচতলার কলাপসিবল গেটের সামনে আনার পর তাঁদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়।

এ সময় নড়াইল জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) কলেজ ক্যাম্পাসে ছিলেন।