শুধু সুপেয় পানির অভাবে উপকূলের মানুষ এলাকা ছাড়বে

২২ মার্চ ছিল বিশ্ব পানি দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ভূগর্ভস্থ পানি: অদৃশ্য সম্পদ, দৃশ্যমান প্রভাব’। উপকূল অঞ্চলের মানুষকে দিনের একটি বড় সময় ব্যয় করতে হয় খাবার পানি জোগাড় করতে। উপকূলে পানির অভাব নেই, চারদিকেই পানি। তবে সব নোনা। এ কারণে তা খাওয়ার অনুপযোগী। উপকূল অঞ্চলের খাবার পানির সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্তের সঙ্গে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

উপকূলীয় এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ কেন বাড়ছে?

দিলীপ কুমার দত্ত: উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা ছিল, আছে এবং দিনদিন সেটা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ার কারণ দুটি। একটা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে সাগরের লবণ পানি উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ছে। অন্যটি হলো, আমাদের প্লাবনভূমিতে হস্তক্ষেপ করা। বাঁধ দিয়ে পুরো প্লাবনভূমিকে আটকে দেওয়া হয়েছে, খণ্ডিত করা হয়েছে। এ কারণে প্লাবনভূমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। আর জলাবদ্ধ এলাকায় পানি আটকে থাকলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।

প্রশ্ন :

লবণাক্ত পানির কারণে উপকূলীয় এলাকায় কী কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে?

দিলীপ কুমার দত্ত: লবণাক্ততার কারণে পুরো বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনধারণের জন্য যে কার্যকর সম্পর্ক আছে, সেটিও। কারণ, পানি হলো জীববৈচিত্র্যের মূল উপাদান। একটা এলাকার জীবনাচরণ নির্দেশিত হয় পানির কারণে। সুতরাং, পানির বৈচিত্র্য পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার সবকিছুতেই পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষের রোগব্যাধি বাড়ছে, নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। একসময় দেখা যাবে, শুধু পানির কারণে মানুষের স্থানান্তর বেড়ে গেছে। মানুষ উপকূল ছেড়ে অন্য এলাকায় ভিড় করছে।

প্রশ্ন :

খাবার পানির নিশ্চয়তা দিতে কী করা উচিত?

দিলীপ কুমার দত্ত: উপকূলীয় অঞ্চলের জনঘনত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় পানির অভাব নেই, অভাব রয়েছে সুপেয় পানির। জীবনধারণের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার, তা মাথাপিছু অনুযায়ী কমে গেছে। খাবার পানির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রায় ৬০০-৭০০ বছর আগে থেকেই এসব অঞ্চলে বড় বড় দীঘি খনন করা হয়েছিল। খানজাহান আলীসহ অন্যরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, এটাই একমাত্র উপায়। এটা হলো প্রকৃতিগত পদ্ধতি। এই পদ্ধতির কথাই এখন অনেকে বলছেন, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কাজ করছেন না। ইতিমধ্যে যেসব জলাশয় ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি। আসলে আমাদের যেটা প্রয়োজন, আমরা ঠিক তার উল্টো পথে চলছি। আমরা সব সময় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি হলো যেকোনো উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ভূগর্ভস্থ পানির বয়স কমপক্ষে ৬০০ বছর, ওপরে ২ হাজার ৫০০ বছর। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছি, তার বয়স এমনই। এই ভূগর্ভস্থ পানি পূরণ হতে কমপক্ষে ৬০০ বছর লাগবে। বর্তমানে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৯৮ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তা পূরণ হচ্ছে না। যেসব জলাশয় ছিল তা ভরাট হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :

খাবার পানির চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, এটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

দিলীপ কুমার দত্ত: রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট বা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে, এটা শুধু স্বল্প সময়ের জন্য খাবার পানির চাহিদা পূরণ করছে। মনে রাখতে হবে, মিঠা পানির চাহিদা শুধু মানুষের নয়, পরিবেশের প্রতিটি গাছপালা ও জীবজন্তুর জন্যও প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে শুধু মানুষের খাবার পানির চাহিদা মিটতে পারে, কিন্তু পরিবেশের নয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃতিনির্ভর সমাধান। তবে এ ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, উৎসের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

প্রশ্ন :

খাবার পানির চাহিদা মেটাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

দিলীপ কুমার দত্ত: ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল, জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুর ও ড্রামে পানি থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। পুকুরে পানি থাকলে গাছপালা, জীবজন্তু সেখান থেকে পানি পায়। কিন্তু ড্রামে সে সুযোগ নেই। আসলে পানির সমস্যার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে, খাসজমিতে মিঠা পানির আধার তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রচলিত আছে যে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, এটা আসলে কতটুকু সত্য?

দিলীপ কুমার দত্ত: পাহাড় থেকে নেমে আসা ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করলে লবণাক্ততার পরিমাণ তুলনামূলক কম হতো। তবে এটা সত্য যে ভারতের ওই পানি আমরা পাব না। কারণ, পুরো গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ড্রেনেজ এলাকায় সাড়ে ৯২ শতাংশ ভারতে রয়েছে। আমাদের জন্য যেমন ওই পানি প্রয়োজন, ওই দেশের জন্যও তেমন প্রয়োজন। ভারত তো আর তাদের চাহিদা অপূর্ণ রেখে আমাদের পানি দেবে না। তবে, আমাদের যে পানির ন্যায্যতা রয়েছে, সেটি পাওয়া গেলে সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে। অন্তত দিনদিন লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়বে না।