সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই একা হয়ে গেছে তিন বছরের অর্ণা

তিন বছরের অর্ণার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তার দাদা–দাদী
ছবি: প্রথম আলো

তিন বছরঅর্ণা বিশ্বাসের বয়স মাত্র তিন বছর। সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাত-পায়ের ক্ষত নিয়েই উঠানজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্ণাকে দেখে হাহুতাশ করছেন দাদা-দাদি ও প্রতিবেশীরা। সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই সে একা হয়ে গেছে।

অর্ণা নিজেও বুঝতে পারছে না তার মা–বাবা একসঙ্গে মারা গেছেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে কখনো বলছে, ‘মা-বাবা হাসপাতালে’, আবার কখনো প্রশ্নকারীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে। অর্ণার ডান হাত ও ডান পায়ে রয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ঝলসানোর ক্ষত। স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগানো হয়েছে। ব্যথায় হাত নাড়াতে না পারলেও আগের মতোই খেলাধুলা করছে।

গত বুধবার দুপুরে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের কুলটি গ্রামে নিজ ঘরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান অর্ণার বাবা অভিজিৎ বিশ্বাস (৩০) ও মা কেয়া বিশ্বাস (২৭)। সেই সময় তাঁদের সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিল অর্ণাও। প্রাণে বেঁচে গেলেও হাত ও পায়ে ক্ষত রয়ে গেছে।

অভিজিৎ বিশ্বাস পেশায় ছিলেন দিনমজুর। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত ভ্যানও চালাতেন। তাঁর বাবা অসীম বিশ্বাসও ছেলের সঙ্গে একই কাজ করতেন। বছর পাঁচেক আগে নিজের চেষ্টায় তিন কাঠা জমি কিনেছিলেন অভিজিৎ বিশ্বাস। দুই বছর আগে সেখানে টিনের বাড়ি করেছেন। ওই টিনের ঘরে বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে জড়িয়ে অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী মারা যান।

অভিজিতের বাবা অসীম বিশ্বাস কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘অভাবের সংসারে ধীরে ধীরে একটু একটু আলো ফুটাচ্ছিল অভিজিৎ। কিন্তু তা ভোগ করার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। এখন এগুলো কে ভোগ করবে? মেয়েটি অথই সাগরে পড়ল। মেয়েটিকে এখন আমরা কীভাবে রাখব, কোথায় রাখব?’

অভিজিতের মা সুন্দরী বিশ্বাসের কোলেই তাঁর নাতনি। ছোট্ট অর্ণার কথা ভেবে তিনি প্রাণ খুলে কথাও বলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা দিনমজুর। দিনমজুরি করে যা আয় হবে, তা দিয়েই অর্ণাকে মানুষ করব। টাকার অভাবে অভিজিৎ এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। কিন্তু অর্ণাকে যত কষ্টই হোক, আমরা পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করব।’

অভিজিৎ ও কেয়া বিশ্বাসের বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সুন্দরী বিশ্বাস বলেন, সকাল থেকে ছেলে ও বউমা একসঙ্গে ধান মাড়াই করছিলেন। পরে ছেলে পুকুরপাড়ে লাউ কাটতে যান। ওই লাউ বিকেলে কৈয়া বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লাউ কেটে এসে গোসল করে ছেলে-বউমা একসঙ্গে ভাত খান। এরপর তাঁরা একসঙ্গে ঘরে যান। এদিকে তিনি ও তাঁর স্বামী তখন বাড়ির উঠানে ধান মাড়াই করছিলেন।

এ সময় হঠাৎ ‘মা’ বলে একটা চিৎকার শুনতে পান সুন্দরী বিশ্বাস। তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখেন, অভিজিৎ বারান্দায় মাথা গুটিয়ে বসে টিনের বেড়া ধরে কাঁপছে। কেয়াও তাঁর পাশে শুয়ে একইভাবে কাঁপছে। অর্ণা পড়ে আছে মায়ের পাশে। তবে তাঁদের থেকে কিছুটা দূরে।

ছেলে ও ছেলের স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে কিছু না বুঝেই তাঁদের ছাড়াতে গিয়েছিলেন অসীম বিশ্বাস। কিন্তু বিদ্যুতায়িত হয়ে তিনিও ছিটকে পড়েন। পরে তাঁর চিৎকারে এলাকাবাসী ছুটে এসে ঘরের বিদ্যুতের প্রধান সুইচ (মেইন সুইচ) বন্ধ করে অভিজিৎ ও কেয়াকে উদ্ধার করেন। দ্রুত তাঁদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সন্ধ্যার পর লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। রাত ১২টার পর একই শ্মশানে স্বামী-স্ত্রীর লাশ সৎকার করা হয়।

অসীম বিশ্বাস আর সুন্দরী বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ শেষে বাড়ি থেকে বের হতেই চোখে পড়ল বড় একটি ঝুড়িতে লাউ সাজিয়ে রাখা। পাশেই দুটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান। স্থানীয় একজন লাউয়ের ঝুড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য লাউগুলো অভিজিৎ তুলে রেখেছিল।’