৯ বছরেও শেষ হয়নি ২৪৬ মামলার বিচার

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
ফাইল ছবি

বগুড়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় ১০৪টি মামলা দায়ের হয়। পরে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির সময়ে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা, গাড়ি পোড়ানো, মানুষ হত্যাসহ নাশকতার আরও ১৪২টি মামলা দায়ের হয়। এই ২৪৬ মামলার বিচার কার্যক্রম ৯ বছরেও শেষ হয়নি।

বগুড়ার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া সব মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। দু-একটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও শুরু হয়েছে। তবে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের নাশকতার ১৪২টি মামলার অভিযোগ গঠন হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি।

মামলার বিচার কার্যক্রমে বিলম্ব হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল মতিন বলেন, বিচারক সংকট, সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়া, অনেক আসামির জামিন নিয়ে পলাতক থাকা, মারা যাওয়া, বিদেশে যাওয়াসহ নানা কারণে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়েছে। কিছু আসামি প্রথম থেকেই পলাতক রয়েছেন। কিছু আসামি জামিন নিয়ে আদালতে হাজির হচ্ছেন না।

আদালতের একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে নাশকতার বেশির ভাগ মামলায় পুলিশের দায়ের করা এজাহার ও অভিযোগপত্র দুটিই খুব দুর্বল। সুনির্দিষ্ট করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ বা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিও নেওয়া হয়নি। নন্দীগ্রাম থানার একটি মামলায় একজন আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও তিনি নিজে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, অন্য আসামিরা হামলায় জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। এখন এসব মামলার ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ওপর। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ দুর্বল হয়। এতে করে মামলায় আসামিরা খালাস পেতে পারেন।

৩ মার্চ নন্দীগ্রাম গানপাউডার ঢেলে সরকারি কার্যালয় পোড়ানোর ঘটনায় নুরুল ইসলাম মণ্ডলকে প্রধান আসামি করে চারটি মামলায় এক হাজার মানুষকে এবং অজ্ঞাত আরও প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে নুরুল ইসলাম ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

মামলা ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৩ মার্চ রাতে সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে বগুড়া জেলাজুড়ে একযোগে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। হামলা হয় বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, উপজেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসভবন, সরকারি দপ্তর ও রেলস্টেশনে। গানপাউডার ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদের ১৬টি সরকারি দপ্তর এবং উপজেলা চেয়ারম্যান-ইউএনওর বাসভবন ও সরকারি গাড়ি। ১৪৪ ধারা ভেঙে এসব হামলা ও নাশকতা-সহিংসতার সময় গুলিতে নিহত হন ১৮ জন। এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ৩৭ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে। অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামি করা হয় লক্ষাধিক ব্যক্তিকে। তদন্ত শেষে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সরকারি কাজে বাধা এবং নাশকতার ধারায় ১০৪টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

অন্যদিকে ৩ মার্চ নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদে গানপাউডার ঢেলে ১৬টি কার্যালয় পোড়ানো, থানায় হামলা এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসভবন পোড়ানোর ঘটনায় উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণ্ডলকে প্রধান আসামি করে চারটি মামলায় এক হাজার মানুষকে এবং অজ্ঞাত আরও প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে নুরুল ইসলাম ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে চার মামলায় ৬৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

এ ছাড়া সদর, শাজাহানপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় দায়ের হওয়া অন্য মামলায় ৩ হাজার ১৪৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। নাশকতার মামলায় দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল গনি মণ্ডল এবং শেরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দবিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠন করা হয়।

বগুড়া আদালত সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দায়ের হওয়া নাশকতার ২৪৬টি মামলার অভিযুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এসব মামলার প্রায় সব আসামি জামিনে রয়েছেন। জামিন নিয়ে আদালতে অনুপস্থিত সিংহভাগ আসামি।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি মাসুদার রহমান বলেন, ২০১৩ সালের ৩ মার্চ সাইদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে জেলাজুড়ে দুষ্কৃতকারীরা যে ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা অনেক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওই নারকীয় ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ৯ বছরে সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ না হওয়ায় বিচারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলায় জড়িত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন ছিল।