সাতক্ষীরায় করোনা শনাক্তের হার ৫৩ শতাংশের ওপরে, র‍্যাপিড টেস্টের দাবি

সাতক্ষীরা শহরের আমতলা এলাকায় পুলিশের ব্যারিকেড। তৃতীয় দিনের লকডাউনে আজ সোমবার দুপুরেপ্রথম আলো

সাতক্ষীরা শহরের ইটেগাছা এলাকার বাসিন্দা ভ্যানচালক মফিউদ্দিন (৬২)। তাঁর চুল–দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। দুপুরে একজন যাত্রী নিয়ে দাঁড়ালেন বাজার মোড়ে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করতেই মফিউদ্দিন বললেন, ‘ভালো থাকি কেমন করে? স্বামী-স্ত্রী নিয়ে পাঁচজনের সংসার। ভ্যানের ওপর সব। ভ্যান চালাতে পারলে দিন যায়, না চালাতে পারলে অর্ধাহারে থাকতে হয়।’ করোনার শুরু থেকে ভালো যাচ্ছে না তাঁদের সংসার। তারপর নতুন করে লকডাউনে প্রচণ্ড কষ্টে আছেন। পুলিশ ভ্যান চালাতে দিচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে।

সাতক্ষীরায় গরিব মানুষের জীবিকা ও দিনাতিপাতের এই যখন চিত্র, উল্টা দিকে জেলায় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। গতকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে আজ সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫০ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর আগের ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৮৯ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের ২৪ ঘণ্টায়ও ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫০ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। সেদিনও শনাক্তের হার ছিল ৫৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। জেলায় করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করার জন্য নাগরিক সমাজ র‍্যাপিড টেস্ট পদ্ধতিতে বেশি সংখ্যায় করোনা পরীক্ষার জোর দাবি জানিয়েছে।

সাতক্ষীরা শহরের সড়কের মোড়ে মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড। তৃতীয় দিনের লকডাউনে আজ সোমবার দুপুরে
প্রথম আলো

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২০ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে; পাশাপাশি রয়েছে আট শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (​আইসিইউ) এবং আট শয্যার হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (​এইচডিইউ), কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি)। একইভাবে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে রয়েছে ৪০ শয্যার করোনা ইউনিট। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। বড় ২৮টি ও ছোট ৭৪টি সিলিন্ডার রয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের পাইপ সিস্টেমের মাধ্যমে। তবে কোনো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নেই। নেই ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা।

সরেজমিনে আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার করোনা ইউনিটে দেখা যায়, নার্স ও চিকিৎসকেরা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। করোনা ইউনিটের পুরুষ ওয়ার্ডে বসে বসে কান্নাকাটি করছেন কলারোয়া উপজেলার রায়টা গ্রামের পারভিন খাতুন। তাঁর স্বামী কামাল হোসেন (৩৫) করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পারভিন খাতুন বলেন, চিকিৎসক ও নার্স তাঁদের দেখে যাচ্ছেন। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁর স্বামীর অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। তাঁকে আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু সেখানে শয্যা খালি নেই।

একই ওয়ার্ডে একই উপজেলার গোপীনাথপুর এলাকার শামছুর রহমান (৪২) ভর্তি রয়েছেন। তিনি বৃহস্পতিবার ভর্তি হয়েছেন এখানে। তাঁর স্ত্রী পম্পা খাতুন বলেন, তাঁর স্বামীর অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। চিকিৎসক ও নার্স সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দিচ্ছেন।

সাতক্ষীরা শহরের সড়কের মোড়ে মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড। তৃতীয় দিনের লকডাউনে আজ সোমবার দুপুরে
প্রথম আলো

অপর দিকে, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুপুরে সরেজমিনে কথা হয় এক রোগীর বাবা আলাউদ্দিন মোড়লের সঙ্গে। তাঁর ছেলে ইমরান মোড়ল হাসপাতালে ভর্তি আছেন সাত দিন। আগের চেয়ে ছেলের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে জানিয়ে আলাউদ্দিন মোড়ল বলেন, চিকিৎসক ও নার্সরা তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের পাশাপাশি চিকিৎসাও দিচ্ছেন আন্তরিকতার সঙ্গে।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কুদরত-ই-খোদা বলেন, পরিস্থিতি একই রকম রয়েছে। এই হাসপাতালে গতকাল রোগী ছিলেন ৯৭ জন। আজ রোগী রয়েছেন ৯৮ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩৬ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৫ জন।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ফয়সাল আহমেদ পরিস্থিতি উন্নতির দিকে উল্লেখ করে বলেন, শনিবার ও গতকাল রোগী ছিলেন ৪৬ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন ৮ জন। নতুন রোগী কেউ ভর্তি না হওয়ায় এখন রোগী রয়েছেন ৩৮ জন।

সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার বলেন, করোনা পরীক্ষা বেশি বেশি না করলে সাতক্ষীরার অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, দ্রুত রোগী শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশন করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে র‍্যাপিড টেস্টের ওপর জোর দেওয়া উচিত। একই কথা বলেন সাতক্ষীরা-১ আসনের সাংসদ মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। তিনি বলেন, র‌্যাপিড টেস্ট করলে ৩০ মিনিটের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। মানুষ সচেতন হতে পারে। গতকাল কলারোয়া উপজেলায় র‌্যাপিড টেস্ট কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই তলার করোনা ইউনিটের পুরুষ ওয়ার্ডের চিত্র। আজ সোমবার দুপুরে
প্রথম আলো

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হুসাইন সাফায়াত বলেন, পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আজ সকালে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩৬। গতকাল সকালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৩।

র‌্যাপিড টেস্টের ব্যাপারে সিভিল সার্জন বলেন, আগেই শ্যামনগর উপজেলায় র‍্যাপিড টেস্ট চালু করা হয়েছে। গতকাল কলারোয়ায় করা হয়েছে। দু–এক দিনের মধ্যে দেবহাটা ও কালীগঞ্জে র‍্যাপিড পরীক্ষা চালু করা হবে। ভারতের সঙ্গে সীমানা রয়েছে এমন পাঁচটি উপজেলায় চালু করার পর আশাশুনি ও তালা উপজেলায় চালু করা হবে। লোকবল–সংকটের কারণে অনেক কিছু সময়মতো করা যাচ্ছে না।

করোনা উপসর্গ নিয়ে আরও দুজনের মৃত্যু, গ্রামে লকডাউন শিথিল

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল রোববার রাতে দুজন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন কালীগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামের মহরব গাজী (৬৫) এবং সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শাখরা কোমরপুর গ্রামের তামান্না খাতুন (২৩)। এ নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে ২২৯ জনের মৃত্যু হলো। আর করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৯ জন।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কুদরত-ই-খোদা বলেন, মহরব গাজী গতকাল সন্ধ্যায় জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান। তামান্না খাতুন একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে গত শনিবার ভর্তি হন। গতকাল রাত তিনটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।

করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শনিবার সকাল থেকে সাতক্ষীরায় এক সপ্তাহের লকডাউন চলছে। আজ তৃতীয় দিনের লকডাউনে শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে। তারপরও শহরের কিছু ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল চলতে দেখা গেছে। অনেক স্থানে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে শহরের চিংড়ি পোনা বাজার ও বড় বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। আর গ্রামে তো লকডাউন মানা হচ্ছে না বললেই চলে।

সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট এলাকায় চিংড়ি পোনা বাজার এলাকার চিত্র। তৃতীয় দিনের লকডাউনে আজ সোমবার দুপুরে
প্রথম আলো

সাতক্ষীরা শহরে আজ সোমবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, আমতলা, নারিকেলতলা, খুলনা রোড মোড়, পাকাপোল মোড়, নিউমার্কেট মোড়, তুফান মোড়, মেডিকেল কলেজ মোড়, পোস্ট অফিস মোড়, পুরাতন সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন সড়কে পুলিশ বাঁশ, বেঞ্চ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। তারপরও মানুষ পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও ভ্যান চলতে দেখা গেছে। দেখা গেছে কিছু পায়ে হাঁটা মানুষ। শহরের নিউমার্কেট এলাকায় চিংড়ি পোনা বাজারে দুপুর ১২টার দিকে ভিড় লক্ষ করা গেছে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব কিংবা মাস্ক ব্যবহারের কোনো বালাই নেই। শহরের বড় বড় বিপণিবিতানসহ অধিকাংশ দোকান বন্ধ থাকলেও কিছু দোকান খোলা রয়েছে। আবার কিছু দোকানদার দোকানের এক শাটার খুলে দাঁড়িয়ে থাকছে ক্রেতার আশায়। ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশ এলে দ্রুত শাটার বন্ধ করে দিচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব কিংবা মাস্ক ব্যবহারের বালাই নেই।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মানুষ একেবারেই সচেতন নয়। মানুষকে লকডাউনে বাইরে বের না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষ মানছেন না। সড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাহারাচৌকি বসেছে। তারপরও নানা অজুহাতে মানুষ বাইরে বের হচ্ছেন। এসবের পরও লকডাউন সফল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, লকডাউন মানতে ও মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১২টি অভিযান পরিচালনা করে ৪৯টি মামলায় ৫৪ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই আন্তরিক না হলে শুধু লকডাউন দিয়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো কঠিন হয়ে পড়বে।