পূজামণ্ডপে হামলা ধর্মীয় সম্প্রীতিতে চিড় ধরানোর অপচেষ্টা

হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) এবং শ্রীশ্রী চৈতন্যদেবের ভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেটের মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়টি সারা দেশেই সুবিদিত। কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে শুক্রবার দুপুরে সিলেট নগরের হাওলদারপাড়া এলাকার দুটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনাটিকে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতিতে চিড় ধরানোর অপচেষ্টা’ বলে মনে করছেন ধর্মীয় নেতারা। সিলেটের সম্প্রীতি ও পূজামণ্ডপে হামলার বিষয় নিয়ে শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় সিলেট নগরের কালেক্টরেট জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. শাহ আলম ও বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ সিলেট মহানগরের সভাপতি সুব্রত দেবের সঙ্গে। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলেটে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমনকুমার দাশ

সিলেট জেলার মানচিত্র
প্রশ্ন:

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যা ঘটছে, এটিকে কীভাবে দেখছেন?

শাহ আলম: কুমিল্লায় কে বা কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তা আমরা কেউ জানি না। এটা সরকার তদন্ত করে দেখছে। যে বা যারা এ কাজ করেছে, তাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আমরাও চাই, এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কোরআন অবমাননা করা হয়েছে, মুসলমান হিসেবে এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এটা যেন ভবিষ্যতে না হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটা ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে হামলার যে ঘটনা ঘটছে, সেটা খুবই দুঃখজনক।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। কুমিল্লার ঘটনার জেরে যা ঘটছে, সেটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সবাই তো আর অন্যায়কারী না। এক-দুজন হয়তো অন্যায় করেছে, এই দোষীদের শনাক্ত করতে হবে। এর জেরে জ্বালাও-পোড়াও করে মন্দির আক্রমণ করা হবে, এটা ইসলামে জায়েজ না। এটা হারাম। এসবে ইসলাম কখনোই সম্মতি দেয় না।

প্রশ্ন:

সিলেট নগরের দুটি পূজামণ্ডপে শুক্রবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

শাহ আলম: আমাদের দেশ খুবই সুন্দর দেশ। এই সিলেট সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঞ্চল। একে-অন্যের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ, ভালোবাসা ও সম্প্রীতি আছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশে বেশি। তাই হিন্দু সম্প্রদায়সহ যারা এখানে আছে, তারা আমাদের আমানত। আমরা কোনোভাবেই তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারি না। যে ঘটনা ঘটেছে, সে জন্য আমরা দুঃখিত। সরকার যেন দোষীদের শনাক্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেয়, সেটাই আমরা চাই।

আমাদের ইতিহাস যদি লক্ষ করেন দেখবেন, ব্রিটিশ আমলের আগে ৭০০ বছর মুসলমানদের শাসন ছিল এখানে। তখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না, কিন্তু মুসলিম শাসন ছিল। বাদশাহ আলমগীরসহ যাঁরা এই উপমহাদেশ শাসন করেছেন, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ সব অঞ্চলে মুসলিম শাসন ছিল। তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানের যে শক্তি ছিল, ইচ্ছা করলেই তাঁরা অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তো সেটি করেননি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও ওপর তখন জোর-জুলুম বা আক্রমণ করা হয়নি। এই সিলেট অঞ্চলে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার আচরণে মানুষ মুগ্ধ হয়েছেন। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। আমরা যদি নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা করি, তাহলে মানুষ বলবে, এই ধর্ম খারাপ, এতে সন্ত্রাস আছে। আমরা কেন অন্য ধর্মের ওপর আক্রমণ করব? ইসলাম শান্তির ধর্ম, এটা মাথায় রেখেই সবাইকে চলতে হবে।

প্রশ্ন:

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে দেশের কয়েকটি অঞ্চলের মতো সিলেটেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। আপনারা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সুব্রত দেব: কিছু দুষ্কৃতকারী সিলেট নগরের হাওলদারপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়েছে। এটা একটা চক্রান্ত। একটা সাম্প্রদায়িক ও কুচক্রী মহল এর পেছনে আছে। অথচ এই সিলেট অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষই অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই একে অন্যের প্রতি সহমর্মী। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, এমন মনোভাবই এখানকার মানুষ লালন করে। ধর্মীয় সম্প্রীতিতে চিড় ধরানোর অপচেষ্টা থেকেই একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

দুর্গাপূজার সমাপনী দিনে যে ঘটনা সিলেটে ঘটল, এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মনে আঘাত পেয়েছে, কষ্ট পেয়েছে। হামলাকারীদের হামলায় মণ্ডপের ভেতরে থাকা কিছু ভক্ত গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ছাড়া মণ্ডপের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসাবাড়িতে যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ হলো, আক্রমণের ঘটনা ঘটল, এটা তো আরও দুঃখজনক। বিষয়টি সবাইকে ব্যথিত করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসে, সিলেট নগরের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনই লজ্জাকর।

আমাদের দাবি, হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। এ ছাড়া হামলাকারীদের শনাক্ত করাও কঠিন কিছু নয়। কারণ, পূজামণ্ডপের আশপাশে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে, সেখান থেকে ফুটেজ পাওয়া যাবে। হামলার সময় কিছু ব্যক্তি মুঠোফোনেও ভিডিও ধারণ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীও আছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করলেও দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য কোনোভাবেই এই অঞ্চলের উদার ধর্মীয় সংস্কৃতি বিনষ্ট হবে না।

প্রশ্ন:

এ রকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী?

সুব্রত দেব: আসলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে সবাইকেই অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে। ধর্ম হচ্ছে শান্তির বিষয়। ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে কোনোভাবেই অশান্তির পরিবেশ তৈরি করা উচিত নয়। সবার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যেন না ছড়ায়, সেটা ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে পারেন। গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে একটা মহল প্রায়ই অপতৎপরতা চালায়, সেটা সবাইকে বুঝতে হবে। এই সিলেট হচ্ছে উদার মনোভাব ও সম্প্রীতির অঞ্চল। এই সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে।