সিলেটে মেয়রের ‌‘সত্য বয়ানে’ ক্ষুব্ধ আ.লীগ, ফেসবুকে তোলপাড়

'এদের চামড়া এত শক্ত হয়েছে যে গন্ডারের চামড়া থেকে আরও বেশি। এদের গায়েও কিছু লাগে না।’ প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নাম বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষোভে এক স্মরণ অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তাঁর সমর্থকেরা ‘সত্য বয়ান’ নাম দিয়ে এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার শুরু করেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটির এই সদস্যের এমন বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

সর্বশেষ আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে মেয়রের বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কার হগদায় খাওগো বান্দি, ঠাকুর চিনো না’। সিলেট অঞ্চলের প্রচলিত এই প্রবাদের অর্থ দাঁড়ায়, ‘মনিবের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে মনিবকে অবজ্ঞা করা’। আসাদের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তাঁর অনুসারীরা প্রচার শুরু করেছেন। এমন প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

আসাদ উদ্দিন আহমদ সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। রাতে মুঠোফোনে জানতে চাইলে আসাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরিফুল হকের বক্তব্য কটূক্তিমূলক। এর জবাবে তাঁর মতো করে কিছু বললে অশালীন হতো। এ জন্য আমি আমার প্রতিক্রিয়ার শেষে একটি প্রবাদবাক্য দিয়েই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।’

গত ৫ সেপ্টেম্বর এম সাইফুর রহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে মৌলভীবাজারে স্মরণসভায় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও ‘সত্য বয়ান’ হিসেবে প্রচার করা হয়। সেখানে মেয়র বলেন, ‘এই (সিলেট) অঞ্চলে সাইফুর রহমানের যে স্মৃতিগুলো থেকে সাইফুর রহমানের নাম মুছে ফেলে দেয়া হয়েছে; তেমনি আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার নামও মুছে ফেলা হয়েছে। আমাদের নেতা শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলছে। কিন্তু মুছে ফেললেও মানুষের মুখ থেকে নতুন নাম কিন্তু উচ্চারণ করাতে পারছে না। মানুষ এখনো জানে সেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আজকে যেটা গর্ব করে বলেন—বিভাগীয় স্টেডিয়াম, যা-ই বলেন না কেন এই অঞ্চলে বলতে গেলে অনেক বলতে হবে। আমি শুধু বলবো, এদের সম্পর্কে কিছু বলে লাভ নেই। এদেরকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কোনো বক্তব্য আমার মুখেও আসতেছে না। এদের চামড়া এতো শক্ত হয়েছে; যে গন্ডারের চামড়া থেকে আরও বেশি। এদের গায়েও কিছু লাগে না।’

কারও নামোল্লেখ না করে বক্তৃতায় আরিফুল হক আরও বলেন, ‘আর ঘুম থেকে উঠে তারা বিএনপি পরিবারের ওপর, শহীদ জিয়া থেকে শুরু করে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান পর্যন্ত শেষ হয়। তসবির মতো জপতে থাকে। তাদের আর কোনো কাজ নেই। তারা সরকারে বসে ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে ওঠে, কী বলব, ভাষায় বলার মতো নেই। তারা শেষ পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিয়ে এখন লাগছে পদকটা নিয়ে টানাটানি। এদের যে কী দশা হবে আল্লাহ জানে। আসলে তারা ভীত।’

আসাদ উদ্দিন আহমদ

আসাদ উদ্দিন আহমদ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বক্তব্যকে ‘উসকানিমূলক’ ও ‘কটূক্তিমূলক’ দাবি করে তা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান। ফেসবুকে আসাদ লিখেছেন, ‘এসব অসৌজন্যমূলক, অশালীন বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি। মেয়র সাহেব, আপনি ভুলে যাবেন না, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়রের চেয়ারে বসে আছেন এবং ইচ্ছামতো সরকারের টাকার অপচয় করছেন।’

সিলেট নগরীর উন্নয়নে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় সিটি করপোরেশনে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে উল্লেখ করে আসাদ লিখেছেন, ‘আপনি (মেয়র) সেই টাকায় পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে যা ইচ্ছা তা করে যাচ্ছেন। এত গাফিলতি এবং অনিয়মের পরেও সরকার উন্নয়নের স্বার্থে দেশের একসময়ের শীর্ষ তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজ হওয়া সত্ত্বেও আপনার বরাদ্দ বন্ধ করেনি, কিংবা সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরাও কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। কারণ, আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না; বরং সম্প্রীতির রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দুঃখ হয়, এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও আপনি আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের গন্ডারের চামড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। আর কী পেলে আপনার মধ্যে সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেবে?’

জানতে চাইলে শুক্রবার রাতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কী বক্তব্য কীভাবে ছড়িয়েছে, বক্তব্য ঠিক আছে কি না, আমি এখনো তা দেখিনি। তবে যেটুকু মনে পড়ে, সেই অনুষ্ঠানে বলা কথার পুরোটা ছিল আমার রাজনৈতিক আদর্শের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি বক্তব্য। আমি তো কারও নামও উল্লেখ করিনি। কী আর বলব, এখানেই বোঝা যায়, কথা বলার স্বাধীনতা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।’