সিলেট নগরের সড়কে হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমরসমান

সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকায় বাসায় পানি প্রবেশ করায় মালামাল নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন অনেকেই। মঙ্গলবার সকালেছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেট নগরের রোজভিউ হোটেলের সামনে দিয়ে উপশহর এলাকামুখী রাস্তায় থই থই করছে ঘোলা পানি। হোটেল থেকে ১০০ গজ দূরে পানির তোড়ে একটি দীর্ঘদেহী গাছ হেলে পড়ে আছে। সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমরসমান। জমে থাকা পানিতে ভাসছে বারোয়ারি ময়লা-আবর্জনা। কোথাও কোথাও ভাসছে মানুষের মলও। পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

দুই দিন ধরে এ অবস্থা চলছে সিলেট নগরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত শাহজালাল উপশহরে। নগরের মাছিমপুর, সোবাহানীঘাট, কালীঘাট, ছড়ারপাড়, তালতলা, তেরোরতন, মেন্দিবাগ, তোপখানা, কলাপাড়া, জামতলা, মণিপুরি রাজবাড়িসহ অন্তত ২৫টি এলাকায় কমবেশি একই দৃশ্য দেখা গেছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা এখন চলাচল করছেন।

আরও পড়ুন
বৃষ্টি আর উজানের ঢলে সুরমা নদীর পানি উপচে সিলেট নগরে প্রবেশ করেছে। মঙ্গলবার সকালে নগরের মেন্দিবাগ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সুরমা নদীর পানি উপচে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার একাংশ প্লাবিত হয়েছে। এতে নগরের লাখো মানুষ পানিবন্দী জীবন পার করছেন। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক জায়গায় চুলা-নলকূপও ডুবেছে। ক্রমে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০০৪ সালের পর এবারই পানি বেশি দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালে নদী উপচে শহরের কিছু এলাকা প্লাবিত হলেও সেবার পানির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই নগরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি না হলেও সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। সরেজমিন দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে পানি মাড়িয়েই বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ অন্যান্য যান চলাচল করছে। রাস্তা ও নালা-নর্দমা একাকার হয়ে যাওয়ায় অনেক যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।

সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরের খাল-ছড়াগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে না। নদীর পানি উপচে তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত না কমলে পরিস্থিতির আরেকটু অবনতি হতে পারে।
নূর আজিজুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী, সিলেট সিটি করপোরেশন

জামতলা এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী মৃদুলা গুপ্তা জানান, তাঁর বাসার উঠানে হাঁটুসমান পানি। ঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। সকালের পর থেকে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে প্রচুরসংখ্যক জিনিস নষ্ট হয়েছে। জরুরি জিনিসপত্র তিনি খাটসহ উঁচু স্থানে রাখছেন। পাহাড়ি ঢল সুরমা নদীতে অব্যাহত থাকায় রাতে পানি বাড়বে, এমন আতঙ্কে রয়েছেন তাঁরা।

উপশহর এলাকার বি ব্লকের বাসিন্দা ও মুহিবুর রহমান একাডেমির অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামছ উদ্দিন বলেন, তাঁর বাসার সামনে হাঁটুসমান পানি। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকের বাসায় পানি ঢোকায় ভোগান্তি বেড়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় দৈনন্দিন কাজকর্ম কঠিন হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন

নগরের মাছিমপুর এলাকার রাবেয়া মঞ্জিলের সামনে কোমরসমান পানি। ওই বাসার বাসিন্দা ছালেহ বিন ইকরাম (৩৫) বলেন, পানি আরেকটু বাড়লে বাসা ছাড়তে হবে। একই এলাকার মুন্না মিয়া (৪২) বলেন, তাঁর বাসায় পানি ঢুকে পড়ায় তিনি বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাচ্ছেন।

উপশহর জি ব্লকের বাসিন্দা ও নগরের একটি কনসালট্যান্সি ফার্মে কর্মরত যুবক সাব্বির আলম বলেন, মূল রাস্তায় পানি ওঠায় তিনি যানবাহনের সংকটে বাসা থেকে বেরোতে পারছিলেন না। পরে একটি ট্রাক দেখতে পেয়ে সেটিতে উঠে অফিসের উদ্দেশে রওনা হন। প্লাবিত এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দোকানে পানি ঢুকে পড়ায় প্লাবিত এলাকাগুলোয় কয়েক শ দোকান বন্ধ আছে। দোকানের মালামাল নষ্ট হওয়ায় তাঁরা কয়েক কোটি টাকা ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন।

শাহজালাল উপশহর এলাকার প্রধান সড়কে বইছে উজানের পানি। সেই পানি ঠেলে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

ভুক্তভোগী নগরবাসীর কয়েকজন জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলে পাড় উপচে সুরমা নদীর পার্শ্ববর্তী নগরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার পাশ দিয়ে সুরমা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) রয়েছে। নদীতে পানি বেশি থাকায় কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট পানি এসব ছড়া দিয়েও নদীতে মিশতে পারছে না। এ অবস্থায় ছড়া ও নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগের দিনের তুলনায় মঙ্গলবার পানি কয়েক ইঞ্চি বেড়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরের খাল-ছড়াগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে না। নদীর পানি উপচে তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত না কমলে পরিস্থিতির আরেকটু অবনতি হতে পারে। তবে তাঁরা পুরো বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছেন। পানিতে ভাসমান ময়লা-আবর্জনা অপসারণসহ প্লাবিত এলাকার অসুবিধাগুলো দূর করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রধান প্রকৌশলী আরও বলেন, নগরের ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রায় এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁদের শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়েছে। বুধবার থেকে তাঁদের মধ্যে রান্না করা খাবার, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হবে।

আরও পড়ুন