‘সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি’
৭০ বছর বয়সী মো. সাজেদুল। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল এক ঘোড়ার গাড়ি। সম্প্রতি বাসের ধাক্কায় ঘোড়াটির একটি পা কাটা পড়েছে। আয়ের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে এখন দিশাহারা তিনি। বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। এই দম্পতির তিনটি ছেলেসন্তান রয়েছে। কেউ তাঁদের খবর রাখেন না।
সাজেদুলের বাড়ি জামালপুর শহরের ছনকান্দা এলাকায়। স্ত্রী মেহেরুন বেগম। তাঁদের সন্তানদের নাম জানতে চাইলে সাজেদুল বলতে চাইছিলেন না। সন্তানদের প্রতি তাঁর আক্ষেপ আর আক্ষেপ। এত কষ্ট করে সন্তানদের লালন-পালন করে কী লাভ—দীর্ঘশ্বাসে এমন মন্তব্য তাঁর। সরকারি কোনো ভাতাও পান না এই দম্পতি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির পাশের একটি বাগানের মধ্যে আহত ঘোড়াটির কাটা পায়ে ওষুধ দিচ্ছেন সাজেদুল। তিন পা নিয়ে ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে আছে। তবে পা কাটার যন্ত্রণায় ঘোড়াটি ছটফট করছিল। একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম ঘোড়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই সাজেদুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সাজেদুল বলেন, ঘোড়া পঙ্গু হওয়ার পর এক মাস থেকে বেকার হয়ে পড়েছেন তিনি। স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। বয়সের কারণে অন্য কোনো কাজও পান না। তাঁর ৩ শতাংশ জমি ছিল। দুই বছর আগে সেই জমিও সন্তানেরা লিখে নিয়েছেন।
একটি খুপরির মধ্যে থাকেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ছোট্ট ঘরটির পূর্ব অংশটুকু ভেঙে হেলে পড়েছে। ঘরের বেড়াও ভেঙে গেছে। বৃষ্টির মধ্যে পুরো ঘরেই পানি পড়ে। ঘরটি ঝুলঝুল করছে। পাশেই সন্তানেরা থাকেন, কখনো বৃদ্ধ মা-বাবার দিকে ফিরেও তাকান না।
এলাকাবাসী জানান, একসময় সাজেদুলের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। কাজকর্ম করে তিন সন্তানকে নিয়ে ভালোই চলেছে। সন্তানেরা বিয়ে করার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দুটি সন্তান বাড়িতেই থাকেন। আরেকজন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। কেউ কখনো এই মা-বাবাকে দেখেন না।
সাজেদুলের স্ত্রী মেহেরুন বেগমের বয়স ৬০ বছর। বয়সের ভার আর নানা অসুখে তেমন হাঁটাচলা ও কাজকর্ম করতে পারেন না। এর মধ্যে প্রায় ৯ মাস আগে পড়ে গিয়ে মেহেরুন বেগমের ডান হাতটি ভেঙে যায়। চিকিৎসার অভাবে হাতটি এখনো ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। সেই হাতে তেমন কিছুই করতে পারেন না।
আক্ষেপ করে মেহেরুন বলেন, ‘এই সংসারে কতই না কষ্ট করেছি। নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছি। লালন-পালন করে বড় করে তুলেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজ সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি। তারা রান্না করে খায়, কখনো জিজ্ঞেস পর্যন্ত করে না, আমরা খেয়েছি কি না। কী লাভ সন্তানদের মানুষ করে। বুড়ো বয়সে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে কোনোরকমে কিছু টাকা পেত। সেটা দিয়েই দুজনে কোনোরকমে চলতাম। সেটাও বন্ধ। আমাদের মতো মানুষদেরই বিপদ আসে বেশি। আল্লাহ আমাদেরই বেশি পরীক্ষা করে।’
স্ত্রীর কথা শেষ হতেই সাজেদুল বলেন, ‘একসময় দোকানে দোকানে কাজ করেছি। বয়সের কারণে এখন কেউ কাজ দেয় না। তিন হাজার টাকায় একটি বাচ্চা ঘোড়া কিনেছিলাম। সেটা যখন বড় হয়, তখন একটি ঘোড়ার গাড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলাম। প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকার বেশি উপার্জন করতে পারিনি। শরীর তো তেমন ভালো নয়। তারপরও দুজনের পেট চালানোর জন্য প্রতিদিন বের হতাম।’
সাজেদুল জানান, গত মাসে একটি বাসের ধাক্কায় ঘোড়াটির পেছনের বাঁ পা ভেঙে যায়। অর্থের অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না। ফলে সুলতান আলম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দার সহযোগিতায় প্রাণিসম্পদ অফিসের লোকজন চিকিৎসা করিয়েছেন। একটি পা কেটে ফেলে দিয়েছেন। এক পা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি আবার চালানো সম্ভব নয়। ফলে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। সম্বল বলতে আর কিছুই নেই।
থাকার ঘরটি দেখিয়ে সাজেদুল বলেন, ‘ঘরটি থাকার মতো অবস্থায় নেই। পুরো ঘর ভাঙা। আগামী বর্ষায় হয়তো ভেঙে পড়বে। তখন কোথায় থাকব? কত বয়স হয়েছে, কেউ কোনো ভাতা দেয়নি। মেম্বারের কাছেও গিয়েছি। কখনো কিছুই পায়নি। সবচেয়ে বড় আফসোস, সারাটা জীবনই কষ্ট করলাম। মানুষ কষ্ট করে কেন সন্তানদের মানুষ করে। আমি দেখছি কোনো লাভ নেই। এই বয়সেও দুমুঠো ভাতের জন্য কতই না কষ্ট করতে হয়। এখন তো পুরো পথ বন্ধ। দিন-রাতে মিলে হয়তো কোনো দিন একবার, হয়তো কোনো দিন দুবার খাই।’
‘মানুষ কষ্ট করে কেন সন্তানদের মানুষ করে। আমি দেখছি কোনো লাভ নেই। এই বয়সেও দুমুঠো ভাতের জন্য কতই না কষ্ট করতে হয়। এখন তো পুরো পথ বন্ধ। দিন-রাতে মিলে হয়তো কোনো দিন একবার, হয়তো কোনো দিন দুবার খাই।’তিন ছেলে সন্তানের বাবা বৃদ্ধ সাজেদুল
মানুষ কষ্ট করে কেন সন্তানদের মানুষ করে। আমি দেখছি কোনো লাভ নেই। এই বয়সেও দুমুঠো ভাতের জন্য কতই না কষ্ট করতে হয়। এখন তো পুরো পথ বন্ধ। দিন-রাতে মিলে হয়তো কোনো দিন একবার, হয়তো কোনো দিন দুবার খাই।
স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান আলম প্রথম আলোকে বললেন, নিজ চোখে এই পরিবারের অবস্থা দেখলে যে কারও চোখে পানি চলে আসবে। পৌর শহরের মধ্যে একটি পরিবারের এমন করুণ অবস্থা চিন্তাই করা যায় না। দুর্ঘটনার পর ঘোড়াটির চিকিৎসা করাতে না পেরে ঘোড়াটিকে ছেড়ে দেন। রেললাইনের পাশে ঘোড়াটি একরকম পড়ে ছিল। পরে সুলতান ঘোড়ার মালিককে খুঁজে বের করেন। তখন এই বৃদ্ধ দম্পতির এই করুণ অবস্থা সর্ম্পকে অবগত হন। এই পরিবারের জন্য সহযোগিতা হাত বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
বাড়িতেই পাওয়া গেল মেজ ছেলে জুয়েল মিয়াকে। মা–বাবাকে দেখভাল না করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না তিনি। পরে জুয়েল বলেন, ‘আমরাই চলতে পারি না। তাঁদের কীভাবে দেব। আমরাই কোনোরকমে চলছি। ফলে তাঁদের দিতে পারি না।’ কখনো তাঁদের খোঁজখবর রাখেন কি? উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। আরেক ছেলে এই খবর পেয়ে অন্যত্র চলে যান।
জামালপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র ফজলুল হক আকন্দের নিজস্ব এলাকা এটি। বৃদ্ধ দম্পতির বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছরে ১৪ থেকে ১৫ জনকে ভাতায় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ হয়। এর মধ্যে তাঁর এলাকাতে হতদরিদ্রের সংখ্যা বেশি। ফজলুল আরও বলেন, ‘ওই পরিবার সর্ম্পকে আমার কিছুই জানা নেই। তারা আমার কাছে কখনো আসেনি বা কেউ তাদের কথা বলেওনি। যদি আসত, অবশ্যই আমি তাদের জন্য ভাতাসহ সহযোগিতার ব্যবস্থা করতাম। তবে তাদের খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’