স্বপ্ন ছিল চাকরি করে পরিবারের হাল ধরার, এখন শিকলে বন্দী হয়ে দিন কাটে

নিজ ঘরে শিকলে বন্দী হৃদয় হোসেন। গত রোববার ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র ছিলেন হৃদয় হোসেন মীর (২০)। দারিদ্র্য ঘিরে থাকলেও পড়াশোনা ছাড়েননি। পরিবারের আশা ছিল, পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন হৃদয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ঘটা এক ঘটনায় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

মাঝেমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন হৃদয়। কিন্তু চার মাস আগে ঢাকায় চাকরির সন্ধানে গিয়ে মারধরের শিকার হন। এরপর একেবারে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

চার মাস ধরে হৃদয়ের দিন কাটছে ছোট্ট একটি কক্ষে শিকলবন্দী অবস্থায়। ছেলের চিকিৎসায় সহায়–সম্বল খরচ করে এখন নিঃস্ব হৃদয়ের মা-বাবা। ছেলেকে কীভাবে সুস্থ করে তুলবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা।

হৃদয় হোসেন মীর ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের রংমিস্ত্রি মোহাম্মদ তানজের আলী মীরের ছোট ছেলে।

জানতে চাইলে হৃদয়ের বাবা তানজের আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তাঁর ছেলে। পরে জেলা শহরের একটি বেসরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। ২০১৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষার আগে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয় হৃদয়ের। এর জের ধরে ওই সহপাঠীরা তাঁকে মাথায় আঘাত করেন। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে হৃদয়কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওই ঘটনায় হৃদয় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন জানিয়ে তানজের আলী বলেন, বরিশালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করানো হলে সেরে ওঠেন হৃদয়। এরপর ২০১৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও পাস করেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাই প্রায়ই তাঁকে বাড়িতে একটি কক্ষে আটকে রাখতে হতো। একটু সুস্থ হয়ে উঠলে চার মাস আগে ঢাকায় চাকরির সন্ধানে যান হৃদয়। কিন্তু সেখানে পথচারীদের হাতে মার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। সেই থেকে আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন হৃদয়। এখন তাঁকে ঘরের একটি কক্ষে শিকলবন্দী করে রাখতে হচ্ছে।

ছেলের কথা তুলতেই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন হৃদয়ের মা তাজনেহার বেগম। তিনি বলেন, শিকল দিয়ে বেঁধে না রাখলে সবাইকে মারধর করেন তাঁর ছেলে। নিজের ও আশপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলেন। বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে। বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তাজনেহার বেগম। বলেন, ‘ছেলের এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না, বাবা।’

গত রোববার সকালে রাজাপুর গ্রামে হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাঁ পায়ে শিকল দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে হৃদয়কে। এ সময় মাকে শিকল খুলে দিতে বারবার অনুরোধ করেন তিনি। মায়ের কাছে বাড়ির বাইরে যাওয়ার বায়না ধরেন।

হৃদয়ের মা–বাবা জানান, ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে গোয়ালের গরু বিক্রি করেছেন, এনজিও থেকে কিস্তির ঋণ নিয়েছেন, স্বজনদের কাছ থেকেও সহযোগিতা নিয়েছেন। এখন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তাঁরা। ছেলের চিন্তায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না তানজের আলী। সংসারে দারিদ্র্য আরও জেঁকে বসেছে।

এ বিষয়ে কথা হয় পোনাবালিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবারটি ছেলের চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পেলে সুচিকিৎসায় হৃদয় সুস্থ–স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন।

ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক এইচ এম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এই মুহূর্তে হৃদয়ের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তবে ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হলে তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’