স্বাধীনতার ৫০তম বছরে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পেলেন শফিকুর রব
শফিকুর রব ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় শফিকুরকে আটক করে হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। গুলি করে হত্যার পর তাঁর লাশ বধ্যভূমি ফেলে রাখা হয়। দেশমাতৃকার জন্য শফিকুর রব শহীদ হন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর শফিকুরের নাম ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার’ তালিকায় ওঠেনি। স্থানীয় কেউ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেননি।
কয়েক বছর আগে শফিকুরের বড় ভাইয়ের ছেলে তোফায়েল আহমদ (৩৪) চাচার স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সম্প্রতি শফিকুর রবের নাম ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়। শহীদ শফিকুর রবের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ (দক্ষিণ) ইউনিয়নের সফরপুর গ্রামে। তাঁরা দুই ভাই ছিলেন। বড় ভাই প্রয়াত ইমামুর রবের ছেলে হলেন তোফায়েল। তিনি স্থানীয় দক্ষিণভাগ বাজারে ব্যবসা করেন।
আজ শনিবার তোফায়েল আহমদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর চাচা শফিকুর রব দক্ষিণভাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পরে দেশে ফিরে স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতেন। একাত্তর সালের ৫ মে ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় হানাদার বাহিনী তাঁকে আটক করে। পরে তাঁকে জুড়ী উপজেলা সদরের ভবানীগঞ্জ বাজারে অবস্থিত তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। শফিকুরকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে বলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন দাউদ। এর জবাবে শফিকুর চিৎকার করে বলেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। এতে দাউদ ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর ওপর গুলি চালান। ঘটনাস্থলেই শফিকুর শহীদ হন। পরে তাঁর লাশ টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পের পেছনে ‘জগোধারী পুকুর’ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। যুদ্ধের পর স্বজনেরা বধ্যভূমিতে চাপা পড়া বেশ কিছু লাশের সঙ্গে বিকৃত অবস্থায় শফিকুরের লাশ খুঁজে পান। পরে ওই লাশ নিয়ে দক্ষিণভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দাফন করেন। শফিকুর রব চিরকুমার ছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হতে চললেও শফিকুর রবের নাম ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার’ তালিকায় না থাকায় বেশ উদ্বিগ্ন হন তাঁর ভাতিজা তোফায়েল আহমদ। তিনি এ বিষয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চাচার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর স্থানীয় সাংসদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার লিখিত আবেদন করেন। অনেক চেষ্টার পর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি প্রজ্ঞাপনে ১৩৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটভুক্ত হয়। এর মধ্যে সবার শেষে শফিকুর রবের নামও রয়েছে। সম্প্রতি সেই গেজেট তাঁরা সংগ্রহ করেছেন।
তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘ছোটবেলা আব্বাসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে চাচার (শফিকুর রব) গল্প শুনতাম। কিন্তু সরকারি তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় হতাশ হয়ে পড়ি। ২০১৪ সাল থেকে চাচার (শফিকুর রব) স্বীকৃতি আদায়ে চেষ্টা চালানো শুরু করি। বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করেছেন। ২০১৫ সালে আব্বাও মারা যান।’ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে হলেও এই স্বীকৃতি পাওয়ায় তাঁরা আনন্দিত। সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন তোফায়েল।
বড়লেখা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, ‘শফিকুর রব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা খুশি। আমরাও এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলাম। তাঁর স্বজনদের পক্ষ থেকেও অনেক চেষ্টা চালানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শফিকুর রবের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’