
মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসায় দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই হাসপাতালটিতে অ্যাম্বুলেন্স নেই। জরুরি বিভাগ আছে, তবে রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য নেই কোনো স্ট্রেচার। প্যাথলজিক্যাল ল্যাব (পরীক্ষাগার) থাকলেও কোনো প্যাথলজিস্ট নেই। মস্তিষ্কের পরীক্ষায় ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাম (ইইজি) যন্ত্রটি পাঁচ-ছয় মাস চলার পরেই নষ্ট হয়েছিল, ১২ বছরেও তা আর চালু হয়নি। নষ্ট রয়েছে এক্স-রে ও এমআরআই যন্ত্রও।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত এমন মৌলিক নানা সরঞ্জামই নেই জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানে। ফলে রোগীরাও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না।
আবদুর রহমান নামে একজন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রীর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালে এসেছিলেন। রোগী দেখে চিকিৎসক তাঁর স্ত্রীর এমআরআই করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। আবদুর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে ছোট দুই বাচ্চা রাইখা আসছি। এখন অন্য হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করাতে হবে। কখন বাড়ি যাইতে পারব জানি না।’ গত ২২ সেপ্টেম্বর সকালে হাসপাতালটিতে গিয়ে আবদুর রহমানের মতো আরও কয়েকজনকে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের বাইরে যেতে দেখা গেছে।
হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু যন্ত্রে সমস্যা আছে। যেসব যন্ত্র নষ্ট, সেগুলো মেরামত এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্র চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০০৩ সালে ১৮-এর কম বয়সী রোগীদের ওপর ও ২০১১ সালে ১৮-এর বেশি বয়সী রোগীদের ওপর পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী দেশে দুই কোটিরও বেশি জনগোষ্ঠী মানসিক রোগে আক্রান্ত, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে যাঁদের অনেকেই সুস্থ হতেন।
মানসিক রোগী ও মাদকাসক্ত রোগীদের সুচিকিৎসা জন্য ২০০১ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ৫০ শয্যার মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ ২০০ শয্যার হাসপাতালটিতে জনবলসংকটও আছে।
অধ্যাপক আবদুল হামিদ জানান, প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ জন চিকিৎসা নেন। নতুন-পুরোনো মিলে হাসপাতালে গড়ে ১৪০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। জনবলসংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক ছাড়া ২৮ জন শিক্ষক ও ৭ জন মেডিকেল অফিসার আছেন। মূলত এই ৩৫ জনই রোগীদের চিকিৎসা দেন। কিন্তু শিক্ষকেরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকায় মেডিকেল অফিসারদেরই বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাসপাতালটিতে অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে হাসপাতালটির পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে, ২০০৯ সালে ও চলতি বছর একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি।
ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, এই হাসপাতালে আসা রোগীদের অধিকাংশই অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের। তাঁদের অনেকেই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অর্থসংস্থানও করতে পারেন না।
সরেজমিন: হাসপাতালটি ঘুরে দেখা গেছে, গুরুতর অসুস্থ ও বয়স্ক রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য হাসপাতালটিতে স্ট্রেচার নেই, শুধু আছে একটি হুইলচেয়ার। ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে একজন রোগীকে দুজন মিলে ধরাধরি করে লিফট পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেখা যায়। এখানে মোট চারটি লিফট। তবে তিনটির সেন্সর কাজ করে না। লিফটের দরজায় চাপা পড়ে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জানতে চাইলে লিফট পরিচালনাকারী আলতাফ হোসেন বলেন, প্রায় দুই বছর থেকে সেন্সর কাজ করে না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
চারতলা ভবনের হাসপাতালটিতে দ্বিতীয় তলায় উত্তর দিকের কোনায় হাসপাতালটির পরীক্ষাগার। সেখানে গিয়ে প্যাথলজিস্ট পাওয়া যায়নি। দুজন টেকনিশিয়ান ও একজন সহকারীর মাধ্যমে চলে পরীক্ষাগারের কাজ। এতে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক রোগ নির্ণয় হয় না বলে অনেকের অভিযোগ। পরীক্ষাগারে প্যাথলজিস্টের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সার্বিক কার্যক্রমে অসুবিধা হচ্ছে।’
নষ্ট এক্স-রে ও এমআরআই যন্ত্র: হাসপাতালটিতে ২০০৩ সালে একটি ও ২০১০ সালে আরও একটি এক্স-রে মেশিন আনা হয়েছিল। কিন্তু দুটি মেশিনই এখন অচল পড়ে আছে। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের একমাত্র এমআরআই যন্ত্রটিও তিন বছর থেকে নষ্ট। তিন দফা সময় বাড়ানোর পর সর্বশেষ গত আগস্ট মাসের ২০ তারিখের মধ্যে এমআরআই যন্ত্রটি মেরামত করার কথা ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাপান থেকে প্রকৌশলী না আসায় মেশিনটি আর ঠিক হচ্ছে না। জানতে চাইলে যন্ত্রটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেডের প্রকৌশলী আফসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্রটি হিটাচি কোম্পানির। এতে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা আমরা ঠিক করতে পারছি না। এ জন্য জাপানের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সাহায্য প্রয়োজন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বলে তাঁরা আসছেন না।’
এক্স-রে ও এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন উল্লেখ করে হাসপাতালটির এক অধ্যাপক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অনেক সময় মানসিক রোগীরা নিউমোনিয়া, টিউবার কিউলোসিস (টিবি) রোগ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তখন তাঁদের এক্স-রে করা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু এক্স-রে মেশিন না থাকায় রোগীরা সে সেবা পান না। আবার মানসিক রোগ মস্তিষ্কের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এমআরআই মেশিন না থাকায় রোগীদের মস্তিষ্কের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় না। খুব প্রয়োজন হলে অন্য হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এতে রোগী ও তাঁর স্বজনদের ভোগান্তি বাড়ে।