‘স্যার ফেলে দিয়েছি, এখন লাশ কী করব’

প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতে নেওয়া হচ্ছে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। আজ সকালে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আজ বুধবার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হাফেজ শহিদুল ইসলাম। ঘটনাস্থলের পাশের মসজিদের এই ইমামের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে সেদিন গুলিবিদ্ধ সিনহার পানির জন্য আর্তনাদ, ওই অবস্থায় তাঁকে লাথি মারা এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর মুঠোফোনে বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে ওসি প্রদীপের কথা বলার বর্ণনা।

সাক্ষ্য দেওয়া শহিদুল ইসলামের বাড়ি মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের বড়ছড়া গ্রামে। ২০২০ সালে ওই খুনের ঘটনার অনেক থেকে তিনি টেকনাফের শামলাপুর এলাকার বায়তুল নুর জামে মসজিদের খতিব (ইমাম)।

ঘটনাস্থলের তল্লাশিচৌকি থেকে ওই মসজিদের দূরত্ব প্রায় ৪০ ফুট। ঘটনার সময় তিনি মসজিদের ছাদে ছিলেন। ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে এই মামলায় সাক্ষ্য দিলেন শহিদুল। তবে তিনি মামলার কত নম্বর সাক্ষী, তা জানা যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী শহিদুল ইসলাম তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে এসে থামে সিনহার প্রাইভেট কার। পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। সিনহা গাড়ি থেকে বের হতেই পরপর চারটা গুলি ছোড়েন লিয়াকত আলী। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে (সড়কে) লুটিয়ে পড়েন সিনহা। চিৎকার করে বলছিলেন ‘হেল্প হেল্প, পানি পানি’। কিন্তু কেউ তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। উল্টো লিয়াকত আলী বাইরের কেউ যাতে সিনহার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে না পারেন, সে জন্য পাহারা বসিয়েছিলেন। তিনি সিনহার বুকে কয়েকবার লাথিও মারেন।

শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, কিছুক্ষণ পর টেকনাফের দিক থেকে গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এরপর লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন প্রদীপ। তারপর তিনি যান সিনহার দিকে। তখনো সিনহা জীবিত ছিলেন এবং পানি চাইছিলেন। পানি না দিয়ে উল্টো সিনহাকে উত্তেজিত কণ্ঠে গালমন্দ করেন প্রদীপ। একপর্যায়ে সিনহার বুকে লাথি মারেন। পা দিয়ে গলা চেপে ধরে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলেন প্রদীপ। বলেন, ‘স্যার, ফেলে দিয়েছি, এখন লাশ কী করব?’ কিছুক্ষণ পর সিনহার মরদেহ একটি ময়লার গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

আদালত পরিচালনা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। প্রত্যক্ষদর্শী শহিদুলের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ফরিদুল আলমসহ তিন আইনজীবী। এ সময় আদালতের কাঠগড়ায় ছিলেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ মামলার ১৫ আসামি। তাঁদের আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কঠোর নিরাপত্তায় জেলা কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয়।

পরে শহিদুলকে জেরা করেন আসামিপক্ষের অন্তত ১৩ জন আইনজীবী। বরখাস্ত ওসি প্রদীপের পক্ষে সাক্ষী শহিদুলকে জেরা করেন বিশিষ্ট আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ঘটনার সময় শহিদুল মসজিদে ছিলেন না। মসজিদের ছাদ থেকে তিনি প্রদীপের মুঠোফোনে কথাবার্তা বলা, লিয়াকতের সঙ্গে ফিসফিস করে বলা কথা শুনলেন কী করে? ঘটনাস্থল থেকে মসজিদ অনেক দূরে। তা ছাড়া গাছপালায় ঢাকা ছিল। মসজিদের তুলনায় ঘটনাস্থল (তল্লাশিচৌকি) উঁচুতে অবস্থিত। কোনো শক্তিমান অথবা বিত্তবান ব্যক্তি মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে শহিদুল আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।

জবাবে সাক্ষী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের ইচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এসেছি। ঘটনা যা দেখেছি, যা শুনেছি, তা-ই আদালতে উপস্থাপন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, সেদিন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। মসজিদে এশার নামাজও পড়িয়েছেন।

বেলা আড়াইটার দিকে শেষ হয় সাক্ষী শহিদুলকে জেরা। পরে আদালতের বিচারক সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেন ২০, ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর। শহিদুল ইসলামসহ মোট ছয়জন সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলার মোট সাক্ষী ৮৩ জন।

আদালতের পিপি ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন দিন পরবর্তী দফায় সাক্ষ্য গ্রহণ হবে। ওই সময়ে উপস্থিত থাকতে অন্তত ১৫ জন সাক্ষীকে নোটিশ পাঠানো হবে। আসামিপক্ষের অন্তত ১৩ আইনজীবী জেরার নামে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে অযথা সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এতে বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা হতে পারে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করে। ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।

চারটি মামলারই তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। এতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।