হাত এগিয়ে দিয়েও বন্ধুদের বাঁচাতে পারেনি শিশু নাহিদ

ছেলের স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিশু হোসাইনের বাবা আবু সাঈদ মোল্লা। সোমবার বিকেলে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে মা মিমি বেগমের কাছে ভাত খেতে চায় ৯ বছরের শিশু তামান্না আক্তার ওরফে শান্তা। কিন্তু ভাত না খেয়েই খেলতে বেরিয়ে পড়ে সে। তার সঙ্গে খেলতে যায় তিন বন্ধু তমা খাতুন (৮), হোসাইন (৬) ও নাহিদ হাসান (৫)।

খেলার ফাঁকে বাড়ির পাশে নতুন খনন করা একটি পুকুরে গোসল করতে নামে তারা। পাড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের গোসল করা দেখছিল নাহিদ। এক পর্যায়ে পানিতে ডুবে যায় তিনজন। এ সময় বন্ধুদের বাঁচাতে হাত বাড়িয়ে দেয় শিশু নাহিদ। কিন্তু হাত এগিয়ে দিয়েও ওদের বাঁচাতে পারেনি সে।

সোমবার দুপুরে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে একটি পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায় ওই তিন শিশু। তাদের মধ্যে তামান্না আক্তার ওরফে শান্তা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের কামরুল ইসলামের মেয়ে, তমা খাতুন একই গ্রামের হারুণ মোল্লার মেয়ে এবং হোসাইন ওই গ্রামের আবু সাঈদ মোল্লার ছেলে।

তামান্না আক্তার ও তমা খাতুন উপজেলার শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী এবং হোসাইন একই বিদ্যালয়ের প্রাক্‌–প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র ছিল।

আরও পড়ুন

বিকেলে শ্রীরামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ওই তিন শিশুর বাড়িতে চলছে মাতম। একসঙ্গে গ্রামের তিন শিশুর মৃত্যুতে এলাকাবাসীর মাঝেও শোক বিরাজ করছে। তিন শিশুর পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে বাড়িতে শত শত মানুষ গিয়েছেন।

বাড়ির উঠানে বিলাপ করছিলেন তামান্না আক্তারের মা মিমি বেগম। এক পর্যায়ে ভাঙা গলায় বলেন, দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার। এক বছর আগে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ছেলে মারা যায়। মেয়েকে নিয়ে সব স্বপ্ন ছিল তাঁদের। স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছিলেন। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে মেয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। এর পরপরই বেরিয়ে যায়।

কান্নায় ভেঙে পড়ে মিমি বেগম বলেন, ‘এভাবে মা আমার হারায়ে যাবে যদি জানতাম, তবে আর বাইরে যেতে দিতাম না! এখন আমরা কাকে নিয়ে থাকব!’

একমাত্র সন্তান তমা খাতুনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার মা পুতুল বেগম। বুক চাপড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘স্কুল থেকে এসে জামা-প্যান্ট পরিবর্তন করে টিভি দেখছিল ও। কিছু সময় পর টিভি বন্ধ করে খেলতে যায়। পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাই, মা আমার নাই। আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’

বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন শিশু তমা খাতুনের মা পুতুল বেগম
ছবি: প্রথম আলো

ছেলের স্মৃতিচারণা করে বিলাপ করছিলেন হোসাইনের বাবা আবু সাঈদ মোল্লা। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা ছিল। এর মধ্যে আজ হারালেন ছেলেকে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে তিনি বলছিলেন, ‘দুপুরে হোসাইন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ভাত খায়। এরপর সে খেলতে যায়। এই খেলাই ওর কাল হলো। আমার বুক খালি করে বাজান কই গেল, আল্লাহ!’

শিশুর স্বজনেরা জানান, আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে পাশের একটি পুকুরে গোসল করতে যায় ছোট্ট তিন শিশু। অনেকক্ষণ ধরে বাড়িতে না ফেরায় তাদের খুঁজতে যান স্বজনেরা। কিন্তু তিন শিশুকে কোথাও পাচ্ছিলেন না তাঁরা।

একপর্যায়ে পুকুরের পাড়ে ছোট্ট তিন জোড়া স্যান্ডেল দেখে তাঁদের সন্দেহ হয়। পুকুরে খুঁজতে নেমে ওই তিন শিশুর সন্ধান পান স্বজনেরা। এরপর তাদের উদ্ধার করে বাঘারপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।