প্রচারণায় ব্যস্ত হারুন জমাদ্দার । সম্প্রতি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা সদরে
ছবি: প্রথম আলো

কালো রঙের স্যুটে রঙিন ব্যাজ। মাথায় লাল হেলমেট। এমন নজরকাড়া সাজে ৫০ পার হওয়া মানুষটি রিকশায় দাঁড়িয়ে হেলেদুলে স্বরচিত গানে গানে মাইকে চালান নির্বাচনী প্রচারণা। ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রচারণা সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। নতুন নতুন ছড়াগান রচে প্রচারণায় এনেছেন ভিন্নতা। প্রার্থীর গুণকীর্তন করে ছন্দ মিলিয়ে এমন ব্যতিক্রম প্রচারণার জুড়ি মেলা ভার।

প্রচারক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। ওই ব্যক্তির নাম হারুন জমাদ্দার। ৩৬ বছর ধরে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বাজার কমিটির নির্বাচনসহ ৭২টি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন মাইক হারুন নামে। হারুন জমাদ্দারের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মিঠাখালী গ্রামে।

হারুন জমাদ্দার জানান, প্রথম দিকে পারিশ্রমিক ছাড়াই কোনো এক প্রার্থীর পক্ষে মাইকে প্রচারণা করতেন। তখন প্রার্থীর কর্মী হিসেবে অনেকটা শখের বসে এ কাজ করেছেন। নব্বইয়ের দশকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে নিরাপত্তাপ্রহরীর চাকরি নেন। কিন্তু নির্বাচন এলে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে এসে নেমে পড়েন প্রচারণায়। প্রতিটি নির্বাচনে তিনি প্রচারণায় অংশ নিতেন। একসময় তাঁর ব্যতিক্রমী প্রচারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর পর থেকে নির্বাচন এলেই হারুনের কদর বাড়ে। প্রার্থীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে তাঁকে প্রচারণার জন্য নেন। এভাবে প্রচারের কাজটিকে তিনি পেশা হিসেবে নেন। বর্তমানে ডিজিটাল প্রচারণার সময়েও তাঁর কদর কমেনি। বর্তমানে তিনি উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের নির্বাচনে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

জানা যায়, আশির দশকে হারুন জমাদ্দার মঠবাড়িয়া শহরের সেলিম মাইক সার্ভিসের মালিক ফজলুল হকের দোকানে বসে প্রায়ই আড্ডা দিতেন। ঠিক সেই সময়ে (১৯৮৫ সাল) শুরু হয় প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। ফজলুল হকের দোকানে প্রার্থীদের লোকজন মাইক ভাড়া নিতে আসতেন। হারুনও মাইকের সঙ্গে যেতেন প্রচারণায়। সেবার হারুন যে প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এভাবেই শুরু।

১৯৮৫ সালের উপজেলা পরিষদের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত ৭২টি নির্বাচনে তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন। এর মধ্যে আটটি জাতীয় সংসদ, তিনটি পৌরসভা, পাঁচটি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনসহ ইউনিয়ন পরিষদ, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি, বাজার কমিটি ও বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচনে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।

হারুন জমাদ্দার বলেন, ‘সাধারণ যেকোনো ধরনের মাইকিং শুনে মানুষ বিরক্ত হন। একঘেয়েমি প্রচার মানুষের ভালো লাগে না বলেই তাঁরা বিরক্ত হন। কিন্তু আমি প্রচারণায় ভিন্নতা এনেছি। পোশাক, বলার কৌশল ভিন্ন হওয়ায় মানুষ আমার প্রচারণা উপভোগ করেন। মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নেচে–গেয়ে ছন্দে ছন্দে আমি প্রার্থীর গুণকীর্তন করে প্রচারণা করি। ফলে আমার প্রচারণায় ভোটাররা উদ্বুদ্ধ হন। প্রার্থীর বিজয়ে প্রচারণা অনেকাংশে প্রভাব ফেলে বলেই প্রার্থীরা আমাকে বেছে নেন। প্রথমে নেশায় প্রচারণা করলেও এখন এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।’

মঠবাড়িয়া পৌর শহরের জনতা মাইকের মালিক নুরুজ্জামাল বলেন, মানুষকে মুগ্ধ করার মতো অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে হারুনের। এ কারণে নির্বাচন এলেই তাঁর চাহিদা বেড়ে যায়। তাঁকে বাগে নিতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। নির্বাচনের আগেই প্রার্থীরা তাঁকে অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি করেন।

আজকাল ক্যাসেটে কণ্ঠ ধারণ করে মাইকে প্রচার করা হয়। এ কারণে প্রচারকদের দুর্দিন চলছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হারুন জমাদ্দার বলেন, ‘ওই প্রচারে মানুষ মজা পায় না। সারাক্ষণ এক কথা ঘুরেফিরে প্রচারিত হয়। আমার প্রচারে মানুষ আমাকে দেখে, কথা শোনে। নতুন নতুন ছন্দে নানা রকমের কথা শুনে মানুষ আনন্দ পায়। এ কারণে ডিজিটাল যুগেও আমার কদর কমেনি।’