‘...হেইতেই পানির এত তোড়’

পুবালি দমকা বাতাসের দমকে ফুসে উঠছে নদী। বিষখালীপাড়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছাপিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ভেতরে। বাঁধের ভেতরে-বাইরের বাসিন্দাদের ঘরে ঢুকছে পানি। কারও বুকসমান পানি, আবার কারও হাঁটুসমান। তবে সবার মধ্যে একটা মিল—‘আতঙ্ক’। কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে উঁচু চকিতে গুটিসুটি করে নিজ ঘরেই রাত পার করেছেন। আবার কেউ টিকতে না পেরে ছোট ছোট বাচ্চাসহ আশ্রয় নিয়েছেন পাশের উঁচু বাঁধে। উপকূলের জেলা বরগুনার বিপন্ন জনপদে এমনই এক রাত কেটেছে মঙ্গলবারে। তবে ভোরের আলো ফুটলেও আতঙ্কে ভাটা পড়েনি জেলা সদরের ডালভাঙা, লতাবাড়িয়া ও কড়ইতলা এলাকার বাসিন্দাদের।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছাপিয়ে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। রাত পৌনে ১২টা, লতবাড়িয়া, বরগুনা সদর, ২৫ মে
ছবি: প্রথম আলো

বরগুনা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে বিষখালী নদীর তীর লাগোয়া বরইতলা, ডালভাঙা, লতাবাড়িয়া, মাছখালী ও পশ্চিম গোলবুনিয়া গ্রামের অবস্থান। মঙ্গলবার গভীর রাতে বরইতলায় গিয়ে দেখা গেল, বঙ্গোপসাগরের ফুসে ওঠা পানি বিষখালীতে প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। তখন ফেরিঘাটের দোকানদার মিজানুর রহমান স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দোকানের মালামাল, ফ্রিজসহ অন্য সব রক্ষা করতে। সব মালামাল এনে বাঁধের ওপরে স্তূপ করে রাখছিলেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি ঘটায় থেমে থেমে আসা বৃষ্টি। হাঁপিয়ে ওঠা মিজানুর বলেন, ‘হারা দিন কিছু খাই নাই। দুপুরের জোয়ারে একবার দোকান তলাইছে। হেই সময় পানি একটু কম অওনে মালামাল রক্ষা পাইছিল। কিন্তু এহন যে অবস্থা, রক্ষা করণের কোনো উপায় দেহি না।’

রাত আরও গভীর। বরইতলা ফেরিঘাট থেকে পশ্চিমে লতাবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল পানির তোড় থেকে বাঁচাতে বাসিন্দাদের হুড়োহুড়ি। কেউ বাচ্চা, কেউ মালামাল কাঁধে নিয়ে বাঁধের ওপরে আসছেন। সেখানে আকলিমা নামের এক গৃহবধূ আতঙ্কের স্বরে বললেন, ‘ঘরে আমার বাচ্চা আর ভাইবোন আটকা পড়ছে। অগো ঘরের মাচায় বইয়্যা থাকতে কইছি। ঘরের মালামাল তো রক্ষা করতে অইবে।’

রাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া দুই নারী। ডালভাঙা, বরগুনা সদর, ২৫ মে
ছবি: প্রথম আলো

আরও পশ্চিমে ডালভাঙা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বাঁধের বাইরের অনেক পরিবার মূল বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছে। তবে মালামাল যাতে খোয়া না যায়, সে জন্য জীবনের ঝুঁকি জেনেও পরিবারের দু-এক সদস্যকে ঘরে রেখে এসেছেন। সোহাগ মিয়া তাঁদের একজন। তিনি বললেন, ‘মোগো জীবন কি এই রহমই যাইবে?’ রাত যত বাড়ছিল জোয়ারের তোড় আর জলের উচ্চতাও তত বাড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল উপকূলের মানুষের আতঙ্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। গাজীপুর, আমতলী, বরগুনা, ২৫ মে
ছবি: প্রথম আলো

ডালভাঙার আরেক গৃহবধূ জায়েদা বলছিলেন, ‘হুনছি বইন্না এহনো আয় নায়। হেইতেই পানির এত তোড়। জানি না বইন্নায় কী অইবে!’ বরগুনাসহ দক্ষিণ উপকূলের মানুষের জীবনের সংগ্রামগুলো সত্যি গল্পের মতো লাগে। কিন্তু তাঁরা যে গল্পের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়েই জীবনকে বেঁধে ফেলছেন, তা দেখা গেল গভীর রাতে, এই জনপদে। তাঁরা জানেন না, এই আতঙ্কের, এই নির্ঘুম রাতের শেষ কোথায়, কোনকালে?