২৭ জেলার সড়কে বন্যার ক্ষত

৫ হাজার ৬৭৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত। সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৭৬২ মিটার।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় নিয়ামতপুর-ফতেপুর সড়কটির বিভিন্ন অংশের পলেস্তারা ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে গর্ত। চলাচলের নেই কোনো উপায়। সম্প্রতি সড়কের হরিনগর এলাকায়ছবি: খলিল রহমান

প্রথম দফার বন্যার সময় গত জুন মাসে পানির স্রোতে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর সেতুর পূর্ব পাশের ২২০ মিটার ধসে যায়। এরপর থেকে জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। জেলা সদরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াতের প্রধান সড়কের এমন অবস্থায় উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগের বছরের বন্যাতেই সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এবার বন্যার পানি নেমে গেলেও কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত। লোকজনকে আনোয়ারপুর এলাকায় এসে ভাঙা অংশ হেঁটে পার হয়ে নতুন করে যানবাহনে উঠতে হচ্ছে। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকার মানুষ।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এলজিইডির সদর দপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণ শাখা সূত্রে জানা যায়, বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার মধ্যে ১৮ আগস্টের হিসাব অনুযায়ী ২৭ জেলায় ৫ হাজার ৬৭৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪ হাজার ৭৬২ মিটার (১৪ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার) সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন জেলার এলজিইডি কার্যালয় থেকে সদর দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তিন দফা বন্যায় মোট ৩৩টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এটাকে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে বলা যাবে না। আর জেলা পর্যায় থেকে পাঠানো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আরও যাচাই–বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে।

২০১৯ সালের বন্যাতেও এলজিইডির কয়েক হাজার কিলোমিটার সড়ক ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলোর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণকাজই এখনো শেষ হয়নি। গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতুর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে এলজিইডি। এর মধ্যেই চলতি বছরের বন্যায় নতুন আরও অনেক সড়ক ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যায় সড়ক ও সেতুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৩৯৪ কোটি টাকা। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে এবং উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে জেলার বিভিন্ন উপজেলার মূল সড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

এলজিইডির সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখনো গ্রামীণ অনেক সড়কে বন্যার পানি রয়েছে।
তাই ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে একটা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো সংস্কারের কাজ শুরু হবে।

গত ২৭ জুলাই টাঙ্গাইল সদর উপজেলার লৌহজং নদের ওপর সেতুর সংযোগ অংশ ধসে যায়। এতে সদর উপজেলার গালা, কুইজবাড়ি, হটিবাড়ীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী কালিহাতী উপজেলার বাঁশি ও এলেঙ্গার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজহার মিয়া বলেন, সড়ক ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্থানীয়দের যাতায়াতের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। দুই পারের লোকজনকে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

এলজিইডি সূত্র জানায়, প্রতিবছর এলজিইডির বাজেটে সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। আগের অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ শাখা) সেখ মোহাম্মদ মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপাতত চলতি বছরের বাজেটে রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দ থেকে সংস্কারকাজ করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে বাকি সড়ক ও সেতুর সংস্কার ও নির্মাণকাজ করা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যায় একই সড়ক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরকারকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সড়কের নকশা বদলে বিকল্প পথে (যে স্থানে পানির ওঠে না) নতুন সড়ক করারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতুর সংস্কার ও নির্মাণের জন্য এমন একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে এলজিইডি। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতু সংস্কারের বিষয়টিও এই প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, বন্যাপ্রবণ এলাকায় সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে একদিকে বন্যায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বন্যার পানি দীর্ঘ সময় আটকে থাকছে। সড়ক নির্মাণের সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। একই সঙ্গে হাওরের মতো এলাকায় পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ করে যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।