৪ কিলোমিটার পর্যটকে গিজগিজ, ব্যবহার হয় না বাকি অংশ

কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে পর্যটকদের ভিড়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

রোববার বিকেল চারটা। কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট। ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার দীর্ঘ সৈকতের এ পয়েন্টে ‘গিজগিজ’ অবস্থা হাজারো পর্যটকে। টানা কয়েক দিনের ছুটির সময় হলে এ সংখ্যা বেড়ে যায় তিন গুণ।

পর্যটকদের কেউ উত্তাল সমুদ্রে নেমে গোসলে ব্যস্ত, কেউ কোমরপানিতে নেমে মুঠোফোনে ছবি তুলছেন, কেউ দ্রুতগতির জলযান জেট স্কি কিংবা স্পিডবোট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দেন গভীর জলরাশিতে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বালুচরের এপ্রান্ত–ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য নিত্যনৈমিত্তিক।

সুগন্ধার দক্ষিণ দিকের কলাতলী, উত্তর দিকের সিগাল, লাবণী, শৈবাল ও ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার সৈকতে প্রতিদিন সমাগম ঘটে অন্তত ১০ হাজার পর্যটকের। ভরা মৌসুমে এ চার কিলোমিটারে একসঙ্গে তিন লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটার রেকর্ডও আছে।

সুগন্ধা পয়েন্টের সৈকত থেকে ২০০ মিটার দূরে ঝাউবনের পাশে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকার রামপুরা থেকে আসা সাব্বির আহমদ (৪৫)। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট্ট জায়গায় মানুষের গিজগিজ অবস্থা ভালো লাগে না। করোনার ঝুঁকিও রয়ে গেছে। তাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এরপর সাব্বিরের পাল্টা প্রশ্ন, বিশ্বের দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মাত্র ৪ কিলোমিটারে মানুষের গিজগিজ অবস্থা কেন? চার কিলোমিটারে এমন কী আছে, যা অন্য সৈকতে নেই?

সাব্বিরের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত বেসরকারি সি-সেফ লাইফগার্ডের ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে। তিনি জানান, চার কিলোমিটার সৈকতের আশপাশেই ৯০ শতাংশ হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউসের অবস্থান। হোটেল থেকে সকাল, বিকেল কিংবা রাতে যখনই ইচ্ছা পর্যটকেরা সৈকতে নামতে পারেন। এখানে দোকানপাট, উন্নত মানের রেস্তোরাঁ, বিনোদনসুবিধা—সবই হাতের নাগালে। রাতের বেলায় আলোকিত থাকে সৈকত, নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, লাইফগার্ড, উদ্ধারকর্মী—সবই আছে। কিন্তু বাকি ১১০ কিলোমিটারে তার কিছুই নেই।

স্থানীয় লোকজন জানান, এই চার কিলোমিটারের বাইরে দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ারটেক, বাহারছড়া, টেকনাফ সৈকতের ৬ কিলোমিটারেও পর্যটকদের পদচারণা থাকলেও বাকি ১১০ কিলোমিটার একেবারেই অব্যবহৃত।
ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, তিন–চার দিনের টানা ছুটি পেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একসঙ্গে এক থেকে দুই লাখ পর্যটক ছুটে আসেন। ৯০ শতাংশ পর্যটকের বিচরণ থাকে ওই চার কিলোমিটার সৈকতেই। অবশিষ্ট ১১০ কিলোমিটার সৈকতকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

কক্সবাজার সৈকতে সুগন্ধা পয়েন্টে ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নামা এক তরুণীকে সতর্ক করছেন লাইফগার্ডকর্মীরা
ছবি: প্রথম আলো

আবুল কাশেম সিকদারের মতে, চার কিলোমিটারের গিজগিজ অবস্থা দূর করতে বিনিয়োগকারীরা দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ারটেক, বাহারছড়া, শীলখালী, টেকনাফ সৈকতে পৃথক ১০টি ‘ট্যুরিস্ট জোন’ তৈরির কথা বলছেন। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তত্ত্বাবধানে এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পয়েন্টগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। প্রতিটি পয়েন্টে পর্যটকের বসার জন্য ৫০০ চেয়ার-ছাতা, ৫০টির মতো দোকানপাট বসানো যায়। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসার ঘটত। এক জায়গায় গিজগিজ করা লোকগুলো ১০টি পয়েন্টে ভাগাভাগি হলে ঝুঁকিও কমে আসত। কিন্তু সৈকতের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে এ পথে এগোনো যাচ্ছে না।

করোনায় টানা পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১৯ আগস্ট থেকে সমুদ্রসৈকত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার সৈকতে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম সংক্রমণ বাড়াতে পারে, এমন শঙ্কা কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমানের। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে লোকসমাগমের শর্তে সৈকত উন্মুক্ত করা হয়েছিল। এখন মানুষের গিজগিজ অবস্থা শঙ্কাটা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

পর্যটকের চাওয়া নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা

কক্সবাজারের এই ৪ কিলোমিটার সৈকতের ৩টি পয়েন্টে ছাড়া ১২০ কিলোমিটার সৈকতের কোথাও নিখোঁজ পর্যটকের উদ্ধারে কেউ নেই। ঝুঁকি নিয়ে সৈকতে গোসলে নেমে চলতি মাসের কয়েক দিনে মারা গেছেন পাঁচজন। গত পাঁচ বছরে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচানো হয় ৩৫৩ জনকে, যার ৯০ শতাংশ পর্যটক।

সিলেটের হরিপুর থেকে আসা পর্যটক সাজেদুল ইসলাম বলেন, এত টাকাপয়সা খরচ করে মানুষ কক্সবাজারে আসে সমুদ্রে নেমে লোনাজলে শরীর–মন ভেজানোর জন্য। অথচ এত দিনেও সৈকতের অল্পটুকু জায়গা ঘিরে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থাও (সি-নেটিং) করে দিতে পারেনি প্রশাসন। পর্যটকেরা নিরাপদ গোসলের নিশ্চয়তা চান।

সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার মো. সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নেমে প্রতিদিন ১০-২০ জন পর্যটকের ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়। রোববারও বিকেল পর্যন্ত ১৪ জনকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচানো হয়েছে। ভাটার সময় কিংবা গুপ্তখালের কাছে গোসলে নামতে নিষেধ করে প্রচারণা চালানো হয়, উড়ানো হয় লাল নিশানা। কিন্তু সেদিকে নজর থাকে না অনেক পর্যটকের।

সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা গেছেন তিনজন। তাঁদের মধ্যে দুজন যশোর থেকে ভ্রমণে আসা পযটক, অন্যজন কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা।

3. কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া এক তরুণকে উদ্ধার করে আনছেন লাইফগার্ডকর্মীরা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সি-সেফ লাইফগার্ডের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গত পাঁচ বছরে সৈকতে গোসলে নেমে মারা গেছেন ২৩ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন চলতি বছরের ৯ মাসে। চার কিলোমিটার সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধারে তাঁর প্রতিষ্ঠানের আছে ২৮ লাইফগার্ড ও ১০ স্বেচ্ছাসেবী। অবশিষ্ট ১১৬ কিলোমিটার সৈকতে কেউ নেই। অরক্ষিত এ সৈকতে কেউ ভেসে গেলে প্রাণে বাঁচানো কঠিন।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সৈকতে সৃষ্ট গুপ্তখাল কিংবা চোরাবালিতে আটকা পড়ে গত ১৭ বছরে মারা গেছেন ১২২ পর্যটক। সবাই ব্যস্ত সৈকত দখল কিংবা আশপাশের জমি কিনে হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরা বানাতে, লোভনীয় অফার দিয়ে মালিকেরা সৈকত ভ্রমণে আনেন পর্যটকদের। অথচ পর্যটকের নিরাপদ গোসলের গরজ মনে করেন না কেউ।

ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, থাইল্যান্ডের পাতাইয়ার আদলে কক্সবাজার সৈকতের লাবনী পযেন্টে ২০০-৫০০ মিটার এলাকাকে জাল দিয়ে ঘিরে ‘সুইমিং জোন’ করার দাবিতে দুই যুগ ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এখানে কারও জীবনের মূল্য নেই। সৈকতে নেমে কারও মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা হলেই নিরাপদ গোসল নিশ্চিত করতে সবাই এগিয়ে আসত।

সার্বিক বিষয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব) ফোরকান আহমদ বলেন, নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতের ৭০ দশমিক শূন্য ৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা (সৈকত) কউকের অধিক্ষেত্র। তবে অধিক্ষেত্রের মধ্যে কাজ চলছে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও জেলা প্রশাসনের। ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গা। এ কারণে কউকের অধিক্ষেত্র হলেও দ্বৈততা রয়েছে। এ দ্বৈততা দূর করার জন্য মন্ত্রণালয় হয়ে মন্ত্রিসভায় অবহিত করা হয়েছে। অধিক্ষেত্রের সৈকত কউকের নিয়ন্ত্রণে চলে এলে পর্যটকদের নিরাপদ গোসল, পরিকল্পিত উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হবে।