৭৮ বছর বয়সেও অসহায় মানুষের জন্য ‘ডালিয়া আপা’র ছুটে চলা

শেরপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলছেন রাজিয়া সামাদ
ছবি: প্রথম আলো

৪৬ বছর বয়সে ঢাকার ‘আয়েশি’ জীবন ছেড়ে চলে আসেন মফস্বল শহর শেরপুরে। জন্ম–শহরের মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকে শুরু করেছিলেন জীবনের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’। যখন যেখানে মানুষের বিপদে পড়ার খবর পেয়েছেন ছুটে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অসহায়-দরিদ্র মানুষের জন্য একে একে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন সমাজসেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডে।

রাজিয়া সামাদ নামের এই মহীয়সীর বয়স এখন ৭৮ বছর। ৩২ বছর ধরে অসহায় মানুষের সেবায় নিবেদিত এই নারী শেরপুরে সবার কাছে ‘ডালিয়া আপা’ হিসেবে পরিচিত।

দুস্থ রোগীর জন্য রক্তের ব্যবস্থা, রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ, দরিদ্র শিক্ষার্থীকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করাসহ সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন রাজিয়া সামাদ। অনেকেরই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন তিনি।

১৯৪৩ সালে শেরপুর শহরের খরমপুর এলাকায় জন্ম রাজিয়া সামাদের। তাঁর বাবা প্রয়াত খানবাহাদুর ফজলুর রহমান ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার চিফ হুইপ। তাঁর মায়ের নাম লুৎফুন্নেছা। চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন রাজিয়া সামাদ। ১৯৬৪ সালে আবদুস সামাদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আবদুস সামাদ ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। এক মেয়ে ও এক ছেলে রেখে ১৯৮১ সালে তিনি মারা যান। এরপর ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন রাজিয়া। সাত বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৯০ সালে শেরপুরে চলে আসেন তিনি।

রাজিয়া সামাদ

শেরপুরে এসেই তিনি অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। বাবার গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ফটিয়ামারীতে প্রথমে উপমা বিদ্যালয় এবং শহরের সজবরখিলা এলাকায় উপমা হাসপাতাল চালু করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে শহরের খরমপুর এলাকায় ‘শেরপুর ডায়াবেটিক সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এটিকে ডায়াবেটিক হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। এ জন্য শহরের মাধবপুর এলাকায় হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজিয়া ওই হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে ওই হাসপাতালে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৩২ হাজার। প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিসাসেবা নেন প্রায় ২০০ জন। বর্তমানে তিনি হাসপাতালটিতে কিডনি রোগীদের জন্য একটি ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপনের চেষ্টা করছেন।

ডায়াবেটিক হাসপাতালের দরিদ্র রোগীদের সহায়তার জন্য রাজিয়া সুলতানা সুদমুক্ত ঋণ ও আর্থিক অনুদান চালু করেছেন। প্রতিবছর ৫ লাখ টাকার তহবিল থেকে একেকজনকে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। ইনসুলিন কেনার জন্য দরিদ্র রোগীদের সহায়তা করা হয়।

ঝিনাইগাতীর ভালুকা গ্রামের খোদেজা বেগম (৪৮) বলেন, ১৪-১৫ বছর আগে তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এরপর থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এখান থেকে বিনা সুদে ১৫ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন। ওই টাকা তাঁদের কাঠের দোকানে বিনিয়োগ করেছেন। সেখান থেকে যে লাভ হয় তা দিয়ে সংসারের খরচ চালান তিনি।

রাজিয়া সামাদ ‘উজ্জয়িনী’ নামে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন কাজ শুরু করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রায় ৫০০ নারী নকশিকাঁথা তৈরি করা শিখেছেন। তাঁরা এখন স্বাবলম্বী। উজ্জয়িনীর মাধ্যমে অনেক গরিব রোগীর চোখের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। উজ্জয়িনীর ব্যবস্থাপনায় এবং শেরপুরের রোটারি ক্লাব ও ময়মনসিংহের বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের সহযোগিতায় প্রতিবছর নামমাত্র মূল্যে ছানি পড়া অনেক রোগীর চিকিৎসা ও চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবায়যুক্ত রাজিয়া সামাদ উপজেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সর্বশেষ সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব ‘দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার’ লাভ করেন।

রাজিয়া সামাদ বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, রক্ত সৈনিক বাংলাদেশ, জেলা সদর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ পরিষদ, আইভিশন-২০২০, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, খানবাহাদুর ফজলুর রহমান ফাউন্ডেশন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও নিম্নবিত্ত মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে যান তিনি। ৭৮ বছর বয়সেও রাজিয়া সামাদ রক্তদান করেন।

মহামারি করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার দুস্থ ও অসহায় মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেন রাজিয়া। গেল শীতে অসহায় প্রায় দেড় হাজার মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন তিনি।

রাজিয়া তাঁর গ্রামের বাড়িতে এতিম ছেলেমেয়েকে রেখে পড়ালেখার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে ১৫ জন অতিদরিদ্র ছেলেমেয়ে তাঁর সহায়তায় পড়ালেখা করছে। কয়েকজন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন।

রাজিয়া সামাদ রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া দুজন কন্যাশিশুকে নিজের পরিচয়ে বড় করেছেন। এখন তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের একজনের নাম শাহানা সামাদ। ইতিহাসে স্নাতক শাহানা এখন ভূমি জরিপ কর্মকর্তা। শাহানা বলেন, ‘একটি পরিবার একটি পরিচয় দিয়েছে। তাঁর (রাজিয়া) অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমি এ রকম মা পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি। তিনি আসলে সমাজের অসহায় ছেলেমেয়েদের মা।’

শেরপুর শহরের দুর্গানারায়ণপুর এলাকার নিজবাড়ী ‘আনন্দধাম’ চত্বরে গড়ে তোলা বাগানের পরিচর্যা আর বই পড়ে অবসর কাটান রাজিয়া সামাদ
ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবায়যুক্ত রাজিয়া সামাদ উপজেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অবদান রাখার জন্য তিনি সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব ‘দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার’ লাভ করেন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেই রাজিয়া সামাদ আনন্দ পান। শহরের দুর্গানারায়ণপুর এলাকার নিজবাড়ী ‘আনন্দধাম’ চত্বরে গড়ে তোলা বাগানের পরিচর্যা আর বই পড়ে অবসর কাটান তিনি। রাজিয়া সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে নিজের ও পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অনেক সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তাতে আফসোস নেই। তিনি মনে করেন, অর্থ কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছার। সেবা করার কারোর মনোভাব থাকলে, তিনি অবশ্যই মানুষকে সেবা করতে পারেন। রাজিয়া বলেন, ‘আমি সব সময় মনে করি, মানুষের সেবা করা একটি বড় ধর্ম। যত দিন শরীরে শক্তি আছে, তত দিন আমি মানুষের সেবা করে যাব। এটিই আমার ব্রত।’

শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজিয়া সামাদ একজন মহীয়সী নারী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে অসহায় ও দরিদ্র নারী–পুরুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন।