৭ মার্চের ভাষণই যুদ্ধে নামায় মহর আলীকে

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করবেন শুনে সকালেই সেখানে ছুটে যান তরুণ মহর আলী।

মোহাম্মদ মহর আলী সরদার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২২ বছরের তরুণ ছিলেন মোহাম্মদ মহর আলী সরদার। বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁ গ্রামে হলেও, তখন থাকতেন ঢাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন আর জুলুম মহরকে চিন্তিত করত। কিন্তু কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। ওই বছরের ৬ মার্চ দুপুরে জানতে পারেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করবেন। সকালেই সেখানে ছুটে যান তরুণ মহর আলী।

‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।...তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মহর আলী জানান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এ অংশটুকু দেশমাতৃকায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে ব্যাপক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে টালমাটাল সময়টাতে ঢাকার শাজাহানপুরে থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন মহর আলী। ঢাকাজুড়ে পাকিস্তানিদের বীভৎসতা, ২৫ মার্চ রাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ দেখে তিনি দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার শপথ নেন। গ্রামে ফিরে এলাকার তরুণদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে যান।

৫১ বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে মহর প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবেগঘন, হুঁশিয়ারি আর অগ্নিঝরা ভাষণেই আমরা আগামীর বাংলাদেশের ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। যেদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেন। আমরা সেদিন লাঠি হাতে রেসকোর্সে উপস্থিত হই। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, লাঠি দিয়েই শত্রুর মোকাবিলা শুরু করতে হবে। ওই ময়দান থেকেই শপথ নিই দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে হবে, যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধে।’

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধে যাওয়া এত সহজ ছিল না। পরিবারের বাধা, রাজাকারদের ভয়। সবকিছু উপেক্ষা করে মায়ের কাছ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে এক কাপড়ে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় পৌঁছাই। সেখান থেকে মেলাঘরে শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিই। এরপর আমাদের নেওয়া হয় বাঘমারা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে এক মাস গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেশে ফিরে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলায় তিন মাস যুদ্ধ করার পর আমাদের ৮ নম্বর সেক্টরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভেদরগঞ্জ থানার যুদ্ধকালীন কামান্ডার আবদুল মান্নান রাঢ়ির তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ করি। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আটজন পাকিস্তানি সেনাকে আটক করি। তাদের এক মাস আটকে রেখে মাদারীপুর ক্যাম্পে তুলে দিই।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে খানিকটা আক্ষেপও প্রকাশ করলেন মহর আলী। তাঁর ভাষ্য, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দেশে পরাজিত শক্তি সক্রিয়। এখনো তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা বারবার তাঁকেও হত্যার চেষ্টা করেছে। এখন নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বাঙালি জাতির মুক্তির সোপান হিসেবে উল্লেখ করেন ভেদরগঞ্জ থানার মুক্তিযুদ্ধকালীন কামান্ডার আবদুল মান্নান রাঢ়ি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণে লাখো তরুণ, ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিকসহ নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে বাড়ি ছাড়ে। ৫১ বছর আগের সে আবেগ-অনুভূতি এখন আর কেউ বুঝতে চায় না। কষ্ট হয়, যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়, কটাক্ষ করা হয়।’