৯ বছর ধরে পড়ে আছে ২৪ কোটি টাকার যন্ত্র

২০১২ সাল থেকে এভাবে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে শক্তিশালী রেডিওথেরাপির যন্ত্র লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর। গতকাল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ২০১২ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেওয়া হয়েছিল একটি শক্তিশালী রেডিওথেরাপির যন্ত্র। ২৪ কোটি টাকা দামের লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর মেশিনটি এত দিনেও কাজে লাগানো হয়নি। বাক্সও খোলা হয়নি। যন্ত্রটির কার্যকারিতা এখন আর নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা।

এই যন্ত্রের বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে বেশ আগেই। যন্ত্রটি সরিয়ে ফেলার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি পাঠিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন, তা এখানে নেই। তা ছাড়া এটা পরিচালনার মতো দক্ষ জনবলও নেই।

এই যন্ত্রের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এঁদের একজন বলেন, খুলনা মেডিকেলে এই যন্ত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছিল না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। তবে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা দেশের ৪০টির বেশি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে ৯৩টি যন্ত্র দীর্ঘদিন অচল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। এর মধ্যে ২৮টি যন্ত্রই ছিল বাক্সবন্দী। এসব যন্ত্রের মধ্যে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও ভেন্টিলেটর রয়েছে। পড়ে থেকে কোনো যন্ত্র নষ্টও হয়ে গেছে। কোনোটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বেশির ভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই জানিয়েছে, যন্ত্র অব্যবহৃত থাকার প্রধান কারণ সংশ্লিষ্ট লোকবলের অভাব। কোথাও কারিগরি সহায়তার অভাবে যন্ত্র বসানো যায়নি।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের চিকিৎসক মো. মুকিতুল হুদা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর জানি যন্ত্রটি ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত ক্যানসার হাসপাতাল থেকে খুলনায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে বা কেন পাঠানো হয়েছিল, তা জানা নেই। এর জন্য হাসপাতাল থেকে কোনো চাহিদাপত্র দেওয়া হয়নি বলে শুনেছি। অত্যন্ত শক্তিশালী রেডিওথেরাপির এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন, তা এই হাসপাতালে নেই।’ তিনি বলেন, যন্ত্রটি শুধু স্থাপন করলেই হবে না, এর অন্যান্য যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার কিনতে খরচ হবে আরও কয়েক কোটি টাকা। তা ছাড়া দরকার অভিজ্ঞ প্রকৌশলী, যা খুলনায় নেই।

হাসপাতালের মূল ভবনের পেছনের দিকে রেডিওথেরাপি বিভাগ। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিভাগে প্রবেশের মূল ফটকের সামনেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। মূল ভবন থেকে ওই জায়গার ওপর বাড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে ছাদ। ওই ছাদের নিচেই রয়েছে বিশাল এক কাঠের বাক্স। ভবনটিতে প্রবেশের সিঁড়িতেও লম্বা করে রাখা হয়েছে আরেকটি বাক্স। ওই বাক্সের পাশ দিয়েই ভবনের ভেতরে ঢুকতে হয়। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কয়েকজন ওই বাক্সে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন।

ভবনের নিচতলায় পূর্বদিকের এক কোনায় রয়েছে মেঝে থেকে ছাদ বরাবর আরেকটি লম্বা কাঠের বাক্স। এর বিভিন্ন অংশে পচন ধরেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সামনের বড় বাক্সে রয়েছে লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর যন্ত্র। আর অন্যান্য বাক্সে রয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। ওই যন্ত্রের একটা বড় অংশ ছিল পূর্বদিকের এক কক্ষে। ক্যানসার রোগী বাড়তে থাকায় ওই কক্ষ এখন কেমোথেরাপির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আর ওই কক্ষে থাকা যন্ত্রাংশগুলো রেডিওথেরাপি কক্ষে রেখে সেটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ওই লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর যন্ত্র নিয়ে ‘ক্যানসার ইউনিটের লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর মেশিন, বারান্দায় প্যাকেটবন্দী ৪ বছর’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক আনন্দ মোহন সাহা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর মেশিনটি সে সময় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল। এটি স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয় থেকে টাকা বরাদ্দ পেলেই যন্ত্রটি স্থাপন করা যাবে। কিন্তু গত চার বছরে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, একসময় মন্ত্রণালয় থেকে যন্ত্রটি ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর বদলে ‘কোবাল্ট-৬০’ নামের আরেকটি ছোট যন্ত্র দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু খুলনার মানুষের আন্দোলনের কারণে তা আর হয়নি। তবে এখন রেডিওথেরাপি বিভাগের পেছনের অংশে নতুন করে ভবন নির্মাণ করে তাতে কোবাল্ট-৬০ রেডিওথেরাপি যন্ত্র স্থাপনের জন্য বাংকার তৈরি করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়া মো. রবিউল ইসলাম যন্ত্রটির বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারেননি।