'জীবন-জীবিকা খাইয়া ফালাইছে করোনা'

করোনার প্রভাবে ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তে মাছের আমদানি কমে গেছে। একই কারণে কমে গেছে কেনাবেচাও। ২০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৩৫টি খোলা থাকলেও অনেক ঘরে মাছ আসেনি। এ কারণে ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আড়ত মালিক-শ্রমিকেরা। সম্প্রতি এক রাতে। ছবি: প্রথম আলো
করোনার প্রভাবে ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তে মাছের আমদানি কমে গেছে। একই কারণে কমে গেছে কেনাবেচাও। ২০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৩৫টি খোলা থাকলেও অনেক ঘরে মাছ আসেনি। এ কারণে ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আড়ত মালিক-শ্রমিকেরা। সম্প্রতি এক রাতে। ছবি: প্রথম আলো
>দেশের মধ্যাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহৎ জেলা কিশোরগঞ্জকে বলা হয় উজান-ভাটির মিলিত ধারা, নদী-হাওর-মাছে ভরা জনপদ। এই জেলায় উপজেলা রয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ঢাকার সবচেয়ে কাছের উপজেলা ভৈরব। ১২১ দশমিক ৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন ও ৮৪টি গ্রাম রয়েছে। কৃষি, মৎস্য, বন্দর ও শ্রমনির্ভর অর্থনীতির এই উপজেলায় লোকসংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি। করোনাকালে এই জনপদজুড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী আর প্রান্তিক মানুষের কষ্টের গল্পগুলো ভিন্ন রকম হলেও জীবনযাপনে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো ভীষণ মানবেতর আর দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তাঁদের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাঁদের কষ্টের চিত্র।

মেঘনার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তটির পরিচিতি দেশজোড়া। নিয়মিত পাইকার ছাড়াও হাওরের মাছের স্বাদ পেতে দেশের বহু জায়গা থেকে শৌখিন লোকজন ছুটে আসেন এই আড়তে। প্রবেশপথে বড় বড় কোম্পানির ব্যক্তিগত গাড়ির জটলা যেন নিত্যদিনের চিত্র। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় আড়তের প্রবেশমুখে গিয়ে পথ হারিয়েছি কি না, এমন ভ্রম হয়। ঠেলাঠেলি এবং টুকরি ও মাছভর্তি বাক্সের ভিড়ে যে আড়তের পথ এগোনো যেত না, তার প্রবেশমুখ কিনা জনমানবহীন!

তবে একটু এগোতেই কিছু ঘরে বেচাকেনার ইঙ্গিত মেলে বৈদ্যুতিক বাতির নিভু নিভু আলো দেখে। ‘আল্লাহ ভরসা’ আড়তের বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একটি। করোনা–পূর্ববর্তী সময়ে সন্ধ্যার আগ থেকে মাছে ভরে উঠত প্রতিষ্ঠানটির সম্মুখভাগ। বিক্রির ব্যস্ততায় বিক্রেতার সামান্য কুশলবিনিময়ের সময় ছিল না। তবে এদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও ওই ঘরে একটি মাছও আসেনি। হাত গুটিয়ে মালিক, বিক্রেতা ও ব্যবস্থাপক বসে অলস সময় পার করছিলেন।

করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভৈরবের পাদুকাশিল্পের নাজুক অবস্থা। শিল্পটির সঙ্গে জড়ির লাখো মানুষের মধ্যে অধিকাংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি কিছু কারখানা সচল হলেও ক্রেতা না থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। সে কারণে শ্রমিকের দৈনিক আয়ও কমে গেছে। সম্প্রতি ভৈরব হাজী পাদুকা মার্কেটের এআরএস পাদুকা কারখানা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভৈরবের পাদুকাশিল্পের নাজুক অবস্থা। শিল্পটির সঙ্গে জড়ির লাখো মানুষের মধ্যে অধিকাংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি কিছু কারখানা সচল হলেও ক্রেতা না থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। সে কারণে শ্রমিকের দৈনিক আয়ও কমে গেছে। সম্প্রতি ভৈরব হাজী পাদুকা মার্কেটের এআরএস পাদুকা কারখানা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

মাছ কোথায় প্রশ্নে মালিক আবদুল্লাহ মিয়ার উত্তর, ‘করোনা খাইয়া ফালাইছে।’ বিষয়টি খোলাসা করতে গিয়ে আবদুল্লাহ বলেন, ‘হাওরের মহাজনদের কাছ থেকে মাছ পেতে একদিকে লাখ লাখ টাকা দাদন দিতে হয়, আবার পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হয় বাকিতে। দাদন আর বাকি—এই দুইয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের ব্যবসা এগিয়ে নিতে হয়। পরিবহন বিড়ম্বনার অজুহাতে মহাজনরা মাছ পাঠাচ্ছেন না। আবার একই অজুহাতে নিয়মিত পাইকারেরা মাছ নিতে আসছেন না। দুই দিক থেকে মার খেয়ে আড়তের সবার আলোকিত ঘরে এখন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। জীবন-জীবিকা খাইয়া ফালাইছে করোনা।’

ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তে মোট ঘর দুই শর অধিক। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার হাওর থেকে আহৃত মাছের একটি অংশের বাজারজাত হয় এই আড়তের মাধ্যমে। এক যুগ ধরে এই আড়ত থেকে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দিন দিন রপ্তানির বাজার বড় হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার মাছের একাংশের চাহিদার জোগান যায় এই আড়ত থেকে। দিন দিন আড়তটির জৌলুশ হারালেও এখনো ভালো—দিনে দৈনিক দুই কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। এদিন দেখা গেল, দুই শর অধিক ঘরের মধ্যে মাত্র ৩৫টিতে বাতি জ্বলছে। এর মধ্যে আবার অনেকে ঘরে মাছই আসেনি।

উজ্জ্বল মিয়া ডালায় করে মাছ বিক্রি করেন এক যুগ। তাঁর ডালায় ছিল ১০ থেকে ১২ কেজি ওজনের রুই, ১০ কেজি ওজনের বোয়াল এবং ৭ কেজি ওজনের কাতলা মাছ। এই মাছগুলো এসেছে হাওর থেকে। তিন থেকে চার ঘণ্টা নদীপথ পাড়ি দিয়ে ভালো দামের আশায় এই আড়তে আনা হলেও প্রত্যাশিত দাম উঠছিল না। দাম না ওঠার কারণ জানতে চাইলে উজ্জ্বল বলেন, ‘গাড়িওয়ালা লোক আসা বন্ধ। ফলে দাম দিয়া কেনার লোকও নেই। বেচাকেনায় বড় ধরনের ওলট–পালটের পেছনে একমাত্র কারণ করোনা।’

ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়ত সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল মিয়া জানালেন, করোনার কারণে এখন দৈনিক বিক্রি ঠেকেছে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ লাখে। এই অবস্থায় করোনা চলে গেলেও তাঁদের পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।

পাদুকা গৌরবে নেই সৌরভ
১২ বছরের শিশু শাহপরান মাদ্রাসার ছাত্র। তবে তার বর্তমান ঠিকানা ভৈরব পৌর শহরে হাজী মার্কেটে অবস্থিত ‘এআরএস সুজ’ নামে একটি পাদুকা কারখানা। করোনার দিনগুলোতে লেখাপড়া না থাকায় বাবা ফারুক মিয়ার সহযোগী হয়ে কাজ করছে সে। ফারুক জুতার পুরোনো কারিগর। করোনায় যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের লোকজন পথে বসেছেন, তার মধ্যে পাদুকাশিল্প একটি।

হাজী মার্কেটে সরেজমিনে দেখা যায়, মার্কেটে ঘর সংখ্যা ৭০০। প্রতিটি ঘরে পাদুকা কারখানা। আর মার্কেটটির সম্মুখভাগের শতাধিক ঘর জুতার পাইকারি দোকান। দেখা যায়, ৯০ শতাংশ কারখানার শাটারে তালা। যে কটি কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল ছিল, তার মধ্যে এআরএস সুজ একটি। ফারুক ও তাঁর শিশুপুত্র এখন ওই কারখানার কারিগর।

করোনার প্রভাবে মাঝিদের আয় ৭০ ভাগ কমে গেছে। আগে দিনে জনপ্রতি এক হাজার টাকা রোজগার করতে পারলেও এখন ৩০০ টাকা হচ্ছে না। সম্প্রতি মেঘনা নদীর ভৈরব বাজার ঘাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
করোনার প্রভাবে মাঝিদের আয় ৭০ ভাগ কমে গেছে। আগে দিনে জনপ্রতি এক হাজার টাকা রোজগার করতে পারলেও এখন ৩০০ টাকা হচ্ছে না। সম্প্রতি মেঘনা নদীর ভৈরব বাজার ঘাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

করোনাকালের হালহকিকত জানতে কথা হয় ফারুকের সঙ্গে। কেমন আছেন প্রশ্ন রাখতেই কারখানার এক কারিগরের মুখ ফসকে ‘ভালোই’ বলতেই ফারুক খেপে গিয়ে বলেন, ‘মিছা কথা কস ক্যান? আমরা কি ভালা আছি?’ ফারুকের উচ্চ স্বর শুনে অন্যরা মাথা নিচু করে থাকেন। কেন ভালো নেই জানতে চাইলে তখন ফারুকের কথা যেন থামে না।

ফারুক বলেন, করোনার আগে দিনে স্বাভাবিক আয় ছিল ৮০০ টাকা। জুতার মূল মৌসুম শুরু হয় ঈদুল ফিতরকে ঘিরে। ঈদুল আজহাতেও চাহিদা বাড়ে। এবার করোনা তাঁদের দুই মৌসুমই খেয়ে নিয়েছে। টানা তিন মাস ছিলেন কর্মহীন। সপ্তাহ খানেক আগে কারখানা চালু করা হলেও উৎপাদনপ্রক্রিয়া সচল রাখতে হয়েছে সীমিত পরিসরে। চাহিদা না থাকায় উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে রোজগারে বড় ধরনের টান পড়েছে ফারুকের।

জানা গেল, এখন তিনি দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার বেশি রোজগার করতে পারছেন না। একটু বাড়তি আয়ের আশায় শিশুপুত্রটিকেও কাজে নিয়ে এসেছেন। ফারুক বলেন, করোনা শুরু পর প্রথম মাস চলেছেন সঞ্চয়ের টাকা থেকে। পরের দুই মাসের জোগান এসেছে ঋণ করে আনা টাকা থেকে। এখন সব দুশ্চিন্তা—সংসার খরচ চালিয়ে রাখার পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করা। তবে উৎপাদন না বাড়লেও সুদ বেড়ে চলায় ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না তাঁর।

অপেক্ষমাণ ভিক্ষুকদের লম্বা সারি। ভিক্ষুক সিরাজ মিয়ার ভাষ্য, ভিক্ষার ৪০ বছরের ভালো-মন্দ দিন গেছে, কিন্তু এই কয়েক মাসের এমন দিনের দেখা আর পাননি। আগে দিনে হাজারের নিচে আয় নামত না। আর এখন দিন পার হয়ে গেলেও পকেটে আর টাকা ঢোকে না। সম্প্রতি ভৈরব পৌর কবরস্থানের প্রবেশপথে। ছবি: প্রথম আলো
অপেক্ষমাণ ভিক্ষুকদের লম্বা সারি। ভিক্ষুক সিরাজ মিয়ার ভাষ্য, ভিক্ষার ৪০ বছরের ভালো-মন্দ দিন গেছে, কিন্তু এই কয়েক মাসের এমন দিনের দেখা আর পাননি। আগে দিনে হাজারের নিচে আয় নামত না। আর এখন দিন পার হয়ে গেলেও পকেটে আর টাকা ঢোকে না। সম্প্রতি ভৈরব পৌর কবরস্থানের প্রবেশপথে। ছবি: প্রথম আলো

এআরএস সুজের মালিক আল আমিন জানালেন, স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁর কারখানায় কারিগর চাহিদা ৩০ জন। লকডাউনের বন্ধের পর নতুন করে আটজন দিয়ে চালু করেছেন। চাহিদা না থাকায় আরও কয়েকজন কারিগর কমিয়ে আনার চিন্তা করছেন।

আল আমিন ভৈরব পাদুকা কারখানা সমবায় সমিতির সভাপতি। তিনি বলেন, ভৈরবে ছোট–বড় সাত হাজার পাদুকা কারখানা আছে। পাদুকার কাঁচামাল বিক্রির দোকান আছে সহস্রাধিক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক লাখ লোক এই পেশায় জড়িত। করোনা মালিক-কারিগর সবাইকে এক পথে এনে দাঁড় করিয়েছে।

যাত্রীর জন্য মাঝির অপেক্ষা যেন ফুরোয় না
মেঘনা নদীর ভৈরব বাজার ঘাটে যাত্রীর অপেক্ষায় আলমগীর মাঝি। প্রবহমান মেঘনার স্বচ্ছ জলের সঙ্গে তাঁর সখ্য ৩০ বছরের। ২০ মিনিট আগে নৌকায় উঠে বসেছেন তিন যাত্রী। বাকি দুজন যাত্রীর অপেক্ষায় আরও ১০ মিনিট পেরিয়ে যায়। কিন্তু সংখ্যা পাঁচ হচ্ছিল না। শেষে বসে থাকা যাত্রীদের অস্থিরতা আর নেমে যাওয়ার শঙ্কা থেকে তা নিয়েই গন্তব্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হতে হয় তাঁকে।

কথা হলে আলমগীর মাঝি জানান, আটজনের সংসার তাঁর। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। করোনা নৌকার যাত্রী কমিয়েছে ৯০ ভাগ। করোনা–পূর্ববর্তী সময়ে দিনে সব খরচ বাদ দিয়ে স্বাভাবিক আয় ছিল গড়ে ৮০০ টাকা। তিনি বলেন, ভৈরব-আশুগঞ্জের মধ্যে প্রায় ৫০টি নৌকা চলে। করোনার কারণে যাত্রী কমায় অনেকে পুষিয়ে উঠতে পারছে না। সে কারণে অনেকে নৌকা নিয়ে আর ঘাটে আসেন না। এখন নৌকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮।

আগে পারাপারে যাত্রীসংখ্যা নিয়ে সরকারি বিধিনিষেধ না থাকলেও এখন নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে। নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচজনের বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না। অথচ আগে ৩০ জনের নিচে নৌকা ভাসাতেন না। তখন যাত্রীরা সিরিয়ালও পেতেন অল্প সময়ে। এখন করোনার কারণে কমেছে যাত্রী, কিন্তু বেড়েছে সিরিয়ালের সময়। আগে ভাড়া ছিল দ১০ টাকা। করোনার সময় পাঁচজন যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হওয়ায় ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ টাকা। ঘাটখরচ, হাতখরচ ও তেলখরচ মিটিয়ে ভাড়া বাড়লেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মাঝিরা।

কত রোজগার হলো প্রশ্নে আলমগীর উত্তর, ‘না গুনে কমু কেমনে? রাহেন গুইনা লই...’ বলেই মগে হাত রাখেন তিনি। মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে জানালেন, ২৬৫ টাকা।

করোনাকালের দিনযাপনের গল্প শেষ করার আগেই যাত্রীরা তাড়া দেন তাঁকে। তিনজন যাত্রী নিয়েই নৌকা ভাসান তিনি। এরপর সিরিয়ালের পরবর্তী অপেক্ষমাণ মাঝি মোহাম্মদ আলীর যাত্রীর জন্য অপেক্ষা শুরু হয়।

দিন গড়ায়, ভিক্ষার থালিতে জোটে না কিছুই
ভৈরবের যে কটি স্থানে নিয়মিত ভিক্ষুকের দেখা মেলে, তার মধ্যে পৌর কবরস্থানের প্রবেশপথ একটি। এক বিকেলে গিয়ে প্রবেশপথে দেখা মেলে অপেক্ষমাণ ভিক্ষুকদের লম্বা সারি। ১৯ জনের লাইনে দাঁড়ানো প্রথমজন সিরাজ মিয়া। দুই হাত, দুই পা হারিয়ে হুইলচেয়ারে বসতি ৪০ বছরের। বাড়ি কিশোরগঞ্জের উকিলপাড়ায়। কিন্তু বাড়িতে যান না দীর্ঘদিন। ভিক্ষার টাকায় ভৈরবে তাঁর এখন ঘর আছে। আছে ছোটখাটো সংসারও।

করোনার প্রভাবে হোটেল ব্যবসায় ধস নেমেছে। অনেক হোটেলে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলতে হচ্ছে। অনেকে চেয়ার টেবিল কমিয়ে ফেলেছে। অনেকে হোটেল বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
করোনার প্রভাবে হোটেল ব্যবসায় ধস নেমেছে। অনেক হোটেলে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলতে হচ্ছে। অনেকে চেয়ার টেবিল কমিয়ে ফেলেছে। অনেকে হোটেল বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

সিরাজের ভাষ্য, ভিক্ষার ৪০ বছরের ভালো-মন্দ দিন গেছে, কিন্তু এই কয়েক মাসের এমন দিনের দেখা আর পাননি। করোনা–পূর্ববর্তী সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সোনালি অতীতে ফিরে যান তিনি। বলেন, ‘দিনে হাজারের নিচে আয় নামত না। আর এহন অর্ধেক দিন পার হইয়া গেলেও পকেটে আর টেহা ঢুহে না।’

লাইনে দাঁড়ানো ১৯ জন ভিক্ষুকই জানান করোনাকালে আয়ের বড় ধরনের ছন্দপতনের কথা। ৭০ বছর বয়সী আবদুল সালেকের বাড়ি জেলার কটিয়াদীর গচিহাটা গ্রামে। তাঁরও ভিক্ষার বয়স চল্লিশের ওপরে। বিয়ে, সংসার, সন্তান লালনপালন—সবই ভিক্ষার টাকায়।

নেত্রকোনার নাঘরা গ্রাম থেকে আসা জরিনা বেগম (৬০) স্বামী-সন্তান হারিয়ে এখন একা। সালেক ও জরিনা দুজনই জানালেন, দুপুর হয়ে গেলেও থালায় এক টাকাও পড়েনি তখনো।

চুলা এই জ্বলে, এই নেভে
আলকাছ মিয়ার খাবারের হোটেলের ব্যবসা ৫০ বছরের বেশি সময়ের। ভৈরব রেলওয়ে জংশন স্টেশন সড়কে তাঁর ডাল, পুরি, রুটি, ভাতের হোটেল। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা-রাত। কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় আলকাছের হোটেলের চুলায় আগুন বন্ধ নেই। অর্ধশতাব্দীর গৌরবের চলার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। করোনা আসার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর হোটেল ব্যবসাও। এখন আবার ট্রেন চললেও ব্যবসায় গতি আসেনি। খাবার পেতে ক্রেতাদের একসময় যেখানে চেয়ার আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখন সেই হোটেলে পাঁচ সেট টেবিল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তিনটির সব কটি কেবিন।

সরেজমিন অনুসন্ধানে এক সন্ধ্যায় গিয়ে হোটেলটির সর্বত্র দৈন্যর চিত্র চোখে পড়ে। দেখা যায় একটি টেবিলে তিন তরুণ বসে রুটি-ভাজি খাচ্ছেন। বাকি টেবিলগুলো ওঠানো। বেশির ভাগ মেঝে ফাঁকা। ব্যবসার হাল বোঝাতে গিয়ে আলকাছ বলেন, ‘চুলা এই জ্বলে, এই নেভে।’ বিষয়টি স্পষ্ট করেন, ‘অনেকক্ষণ পরপর এক একজন কাস্টমারের দেখা মেলে। কাস্টমারের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর চুলায় আগুন দেওয়া হয়। কাজ শেষে নিভিয়ে ফেলা হয়। এই ধরনের কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে অন্তত দেখা হবে—জীবনের শেষ ভাগে এসে অন্তত এমন ধারণা হয়নি।’

আলকাছ ইশারা করেন তাঁর হোটেলের লাগোয়া আরেকটি হোটেলটির দিকে নজর দিতে। ইশারা পেয়ে নজর গেল হোটেলটিতে। ওটি জয়নাল মিয়ার হোটেল হিসেবে পরিচিত। দেখা গেল, চেয়ারগুলো উল্টে রাখা। মালিক পাতা চেয়ারে ঘুমাচ্ছেন। শুধু তা–ই নয়, পাশের রাজমহল নামের আরেকটি হোটেলও চুলা জ্বালানো আর নেভানোর মধ্যে দিয়েই এগোচ্ছে।

আলকাছ জানান, করোনার আগে তাঁর হোটেলে কর্মচারী ছিলেন ১৬ জন। পালা (শিফট) করে তাঁরা কাজ করতেন। এখন কমিয়ে একজনে নামিয়ে আনা হয়েছে। সুদিন ফিরলে আবার ডাকা হবে—এই বলে বিদায় করা হয়েছে বাকিদের।

বিনোদন ব্যবসায় চরা–ভাটা
মেঘনা নদীর তিন সেতুকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিনোদন অঞ্চলে ভ্রমণপিপাসুদের আনন্দ বিলাতে রয়েছে ১০টি ভ্রমণতরি। এর একটি ‘আনন্দ বিলাস’। ঘুরতে আসা মানুষকে আনন্দ বিলাতেই আনন্দ বিলাসের যত আনন্দ। কিন্তু করোনা লোকজনকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনোদন–সম্পর্কিত ব্যবসাগুলোয়। আর এই কারণেই দুই মাস ধরে ঘাটে বাঁধা আনন্দ বিলাস। ভ্রমণতরিটির তরুণ মালিক রুহুল আমিনের বক্তব্য, ‘ঠাইট মরছি (মরে গেছি)। কাজ নাই। জীবনটা পানি পানি অইয়া গেছে।’

স্বাভাবিক অবস্থায় তিন সেতুর ভৈরব প্রান্তে দিনে পাঁচ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। উৎসবের দিন ও শুক্রবার ছুটির দিনে সংখ্যাটি অনেক বেড়ে যায়। ঘুরতে আসা লোকজনের একটি অংশ ভ্রমণতরির মাধ্যমে মেঘনার স্বচ্ছ জল উপভোগ করেন। ১০টি ভ্রমণতরির সব কটি এখন ঘাটে বাঁধা।

করোনার প্রভাবে মেঘনা নদীর পাড়ে বিনোদন কেন্দ্র এখন লোকশূন্য। ফলে বিনোদনসংশ্লিষ্ট সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। ভ্রমণতরিগুলোও ঘাটে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। সম্প্রতি ভৈরব মেঘনা নদীর তিন সেতুর পাড় এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
করোনার প্রভাবে মেঘনা নদীর পাড়ে বিনোদন কেন্দ্র এখন লোকশূন্য। ফলে বিনোদনসংশ্লিষ্ট সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। ভ্রমণতরিগুলোও ঘাটে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। সম্প্রতি ভৈরব মেঘনা নদীর তিন সেতুর পাড় এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

রুহুল আমিন জানান, সঞ্চয় যা ছিল, সবই শেষ। এখন ধারকর্জে চলছে সংসার। সুদিন কবে আসবে, তার আভাস জানতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদপত্রে চোখ রেখে সময় কাটে তাঁর।

এই অঞ্চলটির একপাশে শিশু বিনোদনের জন্য রয়েছে রেলগাড়ি, নাগরদোলা ও চরকি। আসাদ মিয়া নামের এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে শিশু বিনোদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আসাদ জানান করোনার ধাক্কায় নিজেদের বেসামাল হয়ে পড়ার কথা। তিনি বলেন, ছয়জন কর্মীর মাধ্যমে তিনি তাঁর বিভাগটি চালিয়ে আসছিলেন। করোনা আসার পর সবাইকে বিদায় করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এখন তিনি প্রতিদিন বিকেলে একাই আসেন। এক-দুজন কাস্টমারের দেখা পাওয়া যায়। আগে দিনে ৫ হাজার টাকার মতো আয় আসত। এখন ২০০ টাকাও মিলছে না।

স্বাভাবিক সময়ে এখানে ১০টি ফুচকার দোকান চেয়ার পেতে বসত। সরেজমিনে এগুলোর তিনটির দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে কানন মিয়ার একটি। অঞ্চলটিতে তাঁর ব্যবসা সাত বছর ধরে। কানন জানালেন, কোনো রকমের কষ্ট ছাড়াই আগে এক হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন। এখন ৩০০ টাকা পেতে তীর্থের কাকের মতো কাস্টমারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সভাপতি মো. হুমায়ূন কবির বলেন, ‘ভৈরব বাণিজ্য শহর ও নদীবন্দর ব্রিটিশ আমল থেকে। এখনকার মানুষের অর্থনীতি বেশ গতিশীল। কিন্তু এখন গতিশীল অর্থনীতিতে হ্যাঁচকা টান পড়েছে।’