‘আব্বা কবে টাকা দিবা, ওরা আমাকে খাবারও দেয় না’

শাকিলের স্বজনেরা আহাজারি করছেন। প্রতিবেশীরা এসেছেন সান্ত্বনা দিতে। সোমবার দুপুরে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে ১৫ লাখ মুক্তিপণ দাবি করে শাকিল মিয়া (২৪) নামের এক তরুণকে নির্যাতন করছে একটি মানব পাচার চক্র। নির্যাতনের শিকার শাকিলের স্বজনেরা এ তথ্য জানিয়েছেন। বড় স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন শাকিল। সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে এখন নির্যাতন ও প্রাণনাশের হুমকির মধ্যে কাটছে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত।

শাকিল মিয়া ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের টিটুল মিয়া ও রাবেয়া বেগম দম্পতির ছেলে। দুই ভাইবোনের মধ্যে শাকিল বড়। তিনি ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক (পাস) প্রথম বর্ষে পড়ার সময় পরিবারের সচ্ছলতা আনতে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শাকিল। একমাত্র ছেলের বিদেশে যাওয়ার ভাবনা প্রথমে নাকচ করে দেন দরিদ্র কৃষক বাবা টিটুল মিয়া। পরে ছেলের প্রবল ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে টাকা ধার নিয়ে, জমিজমা বন্ধক রেখে ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করে তুলে দেন প্রতিবেশী মুকুল ঠাকুর নামের এক দালালের হাতে।

ভুক্তভোগী শাকিলের পরিবার জানায়, মুকুল ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকা নিয়ে শাকিলকে পাঠান লিবিয়ায়। গত ১৪ জানুয়ারি লিবিয়ায় পৌঁছান শাকিল। এর পর থেকে তাঁর ওপর শুরু হয় নির্যাতন। বর্তমানে লিবিয়ায় প্রতিদিনই শাকিলকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করছে, পরিবারের কাছে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে চক্রটি।

নির্যাতন সইতে না পেরে শাকিল লিবিয়া থেকে দেশে তাঁর বাবাকে ফোন করেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাকিল বলেন, ‘আব্বা কবে টাকা দিবা, ওরা আমাকে খাবারও দেয় না। আব্বা টাকা না দিলে ওরা আমারে মাইরা ফেলবে।’ জবাবে বাবা টিটুল মিয়া মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি টাকা কোথায় পাবেন, তা ভেবে হাউমাউ করে কাঁদেন।

শাকিলের বোন বৃষ্টি আক্তার বলেন, শাকিলকে গত ৪ জানুয়ারি প্রথমে ভারতে নেওয়া হয়। পরে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়েছে। সেখানে ১২ দিন ধরে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি খাওয়া বন্ধ রেখেছে চক্রটি। নির্যাতনের সময় তাঁদের কল দিয়ে শোনানো হয়। নির্যাতনকারীরা এ দেশেরই, তারা বাংলায় কথা বলে।

বৃষ্টি আক্তার আরও বলেন, মানব পাচার চক্রের সদস্য মুকুল ঠাকুর কিছুদিন আগে দেশে আসেন। দেশে এসে যুবসমাজকে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে নেওয়ার প্রলোভন দেখান। শাকিলকে ইতালি নিয়ে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়। মুকুলের সেই প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই তাঁর ভাই ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন।

শাকিল মিয়া
ছবি: সংগৃহীত

একমাত্র ছেলের এমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন হতদরিদ্র বাবা টিটুল মিয়া। বাড়িতে চলছে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আহাজারি। অসহায় হয়ে পড়েছেন অন্য স্বজনেরাও। সন্তানের জীবন রক্ষায় আকুতি-মিনতি কোনো কাজে লাগছে না। ১৫ লাখ টাকা ছাড়া শাকিলের মুক্তি মিলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে চক্রটি। ২৬ মার্চের মধ্যে টাকা না দিলে শাকিলকে হত্যা হুমকি দেওয়া হয়েছে।

কাঁদতে কাঁদতে অসহায় বাবা টিটুল মিয়া বলেন, তিনি এত টাকা কোথায় পাবেন? যা ছিল শেষ সম্বলটুকু বিক্রয় করে এবং চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করে আগেই তো পাচারকারী মুকুলের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন তো আর কোনো টাকা নেই।

এ বিষয়ে খোঁজ নিতে সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে দালাল ও পাচার চক্রের সদস্য মুকুল ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িটি তালাবদ্ধ। সেখানে কথা হয় মুকুলের প্রতিবেশী কাদের মাতুব্বরের সঙ্গে। কাদের বলেন, মুকুল ঠাকুর বর্তমানে ইতালিতে। তাঁর সঙ্গে গত রোববার রাতে ইমোতে কথা হয়েছে। মুকুল ঠাকুর তাঁকে জানিয়েছেন, শাকিল লিবিয়াতে ‘মাফিয়াদের’ কবজায় রয়েছেন। তিনিও চেষ্টা করছেন মাফিয়াদের কাছ থেকে শাকিলকে মুক্ত করতে।

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনিছুর রহমান বলেন, বিষয়টি জেনেছেন। এখন তাঁকে উদ্ধারের জন্য পরিবার যদি কোনো সহযোগিতা চায়, তাহলে সহযোগিতা করা হবে। ঢাকায় দূতাবাসে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে। তিনি আরও বলেন, পরিবারটি যদি অভিযোগ দেয়, তাহলে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ধরনের কোনো অভিযোগ এখনো পাননি বলে জানান সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।