শরীয়তপুর আদালতের কর্মচারীদের ফি নির্ধারণ করেছে আইনজীবী সমিতি, নানা আলোচনা 

আইনপেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকে বলছেন, এমন একটি সিদ্ধান্ত ঘুষ ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টার শামিল।

শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতি সভা করে বিভিন্ন মামলায় আদালতের পেশকার, পিয়ন ও কোর্ট পুলিশের ফি হিসেবে টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর এ জন্য সভার রেজল্যুশন (কার্যবিবরণী) আদালতের বিভিন্ন কর্মচারী, আইনজীবী ও আইনজীবীর সহকারীদের দেওয়া হয়েছে।

এমন একটি লিখিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আইনপেশাসংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যে নানা আলোচনা দেখা দিয়েছে। ক্ষোভ জানিয়ে কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকে বলছেন, এমন একটি সিদ্ধান্ত ঘুষ ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টার শামিল।

শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা যায়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। নতুন কমিটি ৬ মার্চ কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভা করে আইনজীবী সমিতি ভবনের আলহাজ অ্যাডভোকেট সুলতান হোসেন মিয়া সভাকক্ষে। সভায় সভাপতিত্ব করেন সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেম ও সভা পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুল হাসান।

সভায় বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে ২ নম্বর সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, আইনজীবীদের বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করার জন্য পেশকার, পিয়ন, সি আর ফাইলিংয়ের জন্য ১০০ টাকা ফি। ৩ নম্বর সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, কোনো দরখাস্তে জিআরও, সিআরকে ১০০ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। ৪ নম্বর সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, জামিননামা দাখিলের খরচ মামলাপ্রতি ১০০ টাকার নিচে এবং ২০০ টাকার বেশি নয়। ৫ নম্বর সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, গারদখানায় ও ওকালতনামায় স্বাক্ষরে ১০০ টাকা, সিভিল ফাইলিংয়ে ২০০ টাকা ও হলফনামায় ১০০ টাকা দিতে হবে।

আইনজীবী সমিতির এমন সিদ্ধান্তের একটি রেজল্যুশনের কপি জজকোর্ট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পেশকার, পিয়ন ও কোর্ট পুলিশের জিআরওদের কাছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী সমিতির সভাকক্ষের বেঞ্চে টেবিল পেপারের নিচে রাখা হয়েছে। রেজল্যুশনটিতে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুল হাসানের স্বাক্ষর আছে। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে বিভিন্ন আইনজীবী ও আইন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ফেসবুকে সমালোচনা করে পোস্ট দিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরীয়তপুর জজকোর্টের এক আইনজীবী বলেন, যেকোনো মামলার জন্যই পেশকার, পিওন, বেঞ্চ সহকারী, সেরেস্তাদার ও কোর্ট পুলিশকে (জিআরও) টাকা দিতে হয়। টাকার জন্য নানা ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। আর ওই টাকাটা দিতে হচ্ছে মামলার পক্ষ-বিপক্ষ জনগণকে। এটা যাতে সহনীয় পর্যায়ে দিতে হয়, তার জন্যই আইনজীবী সমিতি রেজল্যুশন করে টাকার হার নির্ধারণ করেছে; কিন্তু কাজটি সঠিক হয়নি। দেশব্যাপী এটা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এতে ঘুষ দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল।

শরীয়তপুর জজকোর্টের আইনজীবী মৃধা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্যদের সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্তটি মোটেও ভালো হয়নি। আমরা বিষয়টি আইনজীবী সমিতির সভাপতিকে অবহিত করেছি। তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।’

সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করেন শরীয়তপুরের আইনজীবী সাফফাত হুমায়রা। তিনি ফেসবুকে পোস্ট করে ওই রেজল্যুশন শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতির কি না, তা জানতে চেয়েছেন। ওই পোস্টের নিচে ২০ জন নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাফফাত হুমায়রা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোর্ট স্টাফদের অনৈতিক টাকার দাবিতে আইনজীবীদের তটস্থ থাকতে হয়। ওটা বন্ধ করার জন্য যদি এমন লিখিত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তা সঠিক হয়নি। আমি আইনের ছাত্র এবং এ পেশার মানুষ হিসেবে এটা সমর্থন করি না। শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতির এই সিদ্ধান্তটা নেগেটিভলি সারা দেশের আইনাঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে। আমরাও চাই এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিচারাঙ্গনের কর্মচারীদের অনৈতিকভাবে টাকা আদায়ের পথ বন্ধ হোক। তাহলে অন্তত সাধারণ মানুষ হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে।’

জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের ১৫ সদস্যর কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ওই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তা উৎকোচ বা ঘুষ দেওয়ার জন্য নয়। ওটা বিভিন্ন মামলার কোর্ট ফি বাবদ নির্ধারণ করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেম ও জজকোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান দীপুকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ফোন করা হয়; কিন্তু তাঁরা ফোন ধরননি। 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না।