‘এমন বান, পানির এত উচ্চতা আগে কখনো দেখিনি’

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার ধোপাছড়িতে বন্যার স্পষ্ট ছাপ এখনো রয়ে গেছে
ছবি: প্রথম আলো

পূর্বে বান্দরবান, উত্তরে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় আর দুই দিকে শঙ্খ নদ। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার ইউনিয়ন ধোপাছড়ি মূলত একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। উপজেলা সদর ও সমতলের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে নেই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। নদী কিংবা ছড়ার ওপর সেতুও নেই। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের অধিকাংশই জলপথের ওপর নির্ভরশীল। ধোপাছড়ির প্রায় ২০ হাজার মানুষ অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসীর মতোই জীবন যাপন করেন।

গতকাল রোববার আমরা গিয়েছিলাম সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। চন্দনাইশ সদর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে দোহাজারি। দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা পৌঁছালাম দোহাজারির চৌকিদার ফাঁড়ির ঘাটে। ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা স্রোতের বিপরীতে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে চলার পর আমাদের ধোপাছড়ি বাজারে নামিয়ে দিল।

ভাঙন–উন্মুখ শঙ্খ তীরের এই বাজারের বহু অংশের সলিলসমাধি হয়েছে বন্যার তোড়ে। তীরে উঠেই বোঝা গেল পানি কী ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এখানে। উঁচু গাছের ডালে, দোকানপাটের চালে প্লাবনের চিহ্ন স্পষ্ট। পানি নেমে গিয়ে কর্দমাক্ত বাজারটিতে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে শুরু করেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দোকান, ঘরবাড়ি মেরামতের চেষ্টা করছেন মানুষ। দোকানের সামনে থেকে তরল কাদা সরাচ্ছেন অনেকে। ভিজে পচে যাওয়া মালপত্তর সরাচ্ছেন দোকানিরা।

মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দোকান, ঘরবাড়ি মেরামতের চেষ্টা করছেন মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

মাহবুব নামের একজন দোকানদার আমাদের দেখে বললেন, ‘অবাজী ইতি বেয়াগ হাই ফেলাইয়ে। বেয়াগ টানি লই গেইয়ুগুই ডাহাইতর ডইল্লা।’ (ও বাপ, সে সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। ডাকাতের মতো সব টেনে নিয়ে চলে গেছে।) মাহবুবের কথা শুনে আমরা ভাবলাম হয়তো ডাকাতি হয়েছে। পরে বোঝা গেল এ ডাকাত আর কেউ নয়, শঙ্খ।
ধোপাছড়ি বাজার এবং তার আশপাশের এলাকায় ২০৯টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭টি ঘর এবং ২০টি দোকান ভাসিয়ে নিয়ে গেছে শঙ্খ নদ। পাহাড় পরিবেষ্টিত জনপদ ধোপাছড়ির প্রাকৃতিক লাবণ্যও মলিন হয়ে পড়েছে। ঝড়বাদলে ঘরবাড়ি হারিয়ে বাসিন্দারা হয়ে পড়েছেন আশ্রয়হীন। দোকানিরা পড়েছেন লোকসানে আর বানের ঢলে কৃষকেরা হয়েছেন নিঃস্ব।

ধোপাছড়ি ইউনিয়নের ত্রিপুরাপাড়া, কেয়াঙপাড়া, শঙ্খর কুল, চাপাছড়ি, ক্যাম্পপাড়া, শামুকছড়ি, চেমির মুখ, চিড়িঙঘাটাসহ ১৫টি ওয়ার্ড জলাভূমি দ্বারা যুক্ত। এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে যেতে খাল কিংবা শঙ্খ নদী পার হতে হয়। বাজারেই আমাদের সঙ্গে দেখা হলো চিড়িঙঘাটা ওয়ার্ডের সদস্য আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর ওয়ার্ডে ২৬টি বাড়ি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এমন বান, পানির এত উচ্চতা আগে কখনো দেখেননি তিনি। ২০১৯ সালেও একবার বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এত পানি হয়নি। এতটা ধ্বংসাত্মক ছিল না সেই বন্যা।

কাদায় ছাওয়া পথে বাজার থেকে যেতে যেতে আমাদের দেখা হয় পশ্চিম চিড়িঙঘাটার ওয়ার্ড সদস্য মোহাম্মদ করিমুল ইসলামের সঙ্গে। ৯ আগস্ট পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হন তাঁর ওয়ার্ডের তরতাজা যুবক খোকন। তিন দিন পর বহু দূরে আনোয়ারায় পাওয়া যায় তাঁর লাশ। এত দূর একটি মানুষের দেহ কীভাবে ভেসে গেল, সেই রহস্যের কিনারা করতে পারেন না তিনি। অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে তাঁর চোখ। পশ্চিম চিড়িঙঘাটায় প্রায় ৬০টি ঘর ধ্বংস হয়েছে বলে জানান করিমুল।

প্লাবনের তোড়ে উপড়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ধোপাছড়িতে বিদ্যুৎ নেই। বাজারে কর্মরত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা জানান, ধোপাছড়ির বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনতে তাঁরা চেষ্টা করছেন। তবে কবে নাগাদ অন্ধকারাচ্ছন্ন এই বিশাল এলাকাজুড়ে আলো ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউই।

চন্দনাইশের ধোপাছড়ির গ্রামে গ্রামে মানুষের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, নুয়ে পড়া খেতখামার, বাগান
ছবি: প্রথম আলো

ধোপাছড়ির গ্রামে গ্রামে মানুষের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, নুয়ে পড়া খেতখামার, বাগান দেখে ফেরার পথে দেখা হলো ধোপাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল আলীমের সঙ্গে। তিনি ধোপাছড়ি খাল পেরিয়ে বাজারে আসছিলেন। এবারের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির একটা পরিসংখ্যান পাওয়া গেল তাঁর কাছে। তিনি জানালেন, ধোপাছড়িতে ৩০০ ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলোর অধিকাংশই মাটি এবং বাঁশের কাঁচা ঘর। পানিতে ডুবেছে ১০০ ঘর। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লেবু, পেয়ারা, আখ, পেঁপে ও সবজির অসংখ্য বাগান। এই ক্ষতি পুষিয়ে আনতে বেশ সময় লাগবে বলে জানালেন তিনি।

অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় ধোপাছড়ি বেশ বড়। ৭০ শতাংশ এলাকা বনভূমি। বন বিভাগের অধীনে জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অরণ্য। বেশির ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আবদুল আলীম বলেন, কৃষি পণ্য সদরে নিয়ে যেতেও অনেক ভোগান্তি পোহান কৃষকেরা। বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে সদর থেকে যেসব ত্রাণ আসে, সেগুলো আনতেও খরচ পড়ে বেশি।

পাহাড় পরিবেষ্টিত জনপদ ধোপাছড়ির প্রাকৃতিক লাবণ্যও মলিন হয়ে পড়েছে। ঝড়বাদলে ঘরবাড়ি হারিয়ে বাসিন্দারা হয়ে পড়েছেন আশ্রয়হীন
ছবি: প্রথম আলো

ধোপাছড়ি খালের মোহনায় শঙ্খের তীরে একটা সেতু বদলে দিতে পারে এই জনপদের জীবনচিত্র। একটি সেতু হলে বা বান্দরবানের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ হলে এই এলাকা এ দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখতে পারবে বলে জানান আবদুল আলীম। পাহাড়, নদী ও আর অরণ্যঘেরা এই জনপদটিতে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হলে এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এই যুগে যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে একটি এলাকা এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে এটা কল্পনা করাও কঠিন। একজন মানুষ এখানে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি কী রকম একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন, তা কল্পনা করতে গা শিউরে উঠে। ধোপাছড়ির মানুষ এই অন্ধকার থেকে মুক্তি চায়। বন্যাকবলিত, বর্ষাবিঘ্নিত মানুষের চোখে মুখে সেই আকুতিই ফুটে উঠেছে।
(প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন পটিয়া প্রতিনিধি আবদুর রাজ্জাক)