‘তাম্বি হাউসে’ ঈদের আনন্দেও লুকানো বিষাদ

খুলনা সরকারি শিশু পরিবার বালিকাতে ঈদের আনন্দে মেতেছে শিশুরা। একটু পর সাংস্কৃতিক আয়োজন। এর আগে চলছে সেলফি তোলা। গতকাল বৃহস্পতিবার তাম্বি হাউসে
ছবি: প্রথম আলো

স্পিকারে বাজছে গান। ‘ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ’। গানের তালে তালে পুতুলনাচের মুদ্রা ফুটিয়ে তুলে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে একদল শিশু-কিশোরী। মুখে তাদের আনন্দের ঝিলিক। এই শিশুরা থাকে খুলনার সরকারি শিশু পরিবারে। নগরের সাউথ সেন্ট্রাল রোডের ওই বালিকা শিশু পরিবার ‘তাম্বি হাউস’ নামে পরিচিত।

এ হাউসে ১০১ শিশুর বাস। গতকাল বৃহস্পতিবার ঈদের দিন সেখানে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। ওই নাচের দলের একজন মোসাম্মৎ মুসকান আক্তার। এখন পড়ে নগরের পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে। মুসকান জানে না তার বাড়ি কোথায়, মা–বাবা কোথায়? মুসকান ও তার ভাই কোনো এক রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়ে খুলনা স্টেশনে চলে আসে। কীভাবে, কোথা থেকে ট্রেনে উঠেছিল, কিছু বলতে না পারায় ওদের ঠাঁই হয় এ তাম্বি হাউসে।

মুসকানের এবারের ঈদ ভালো কেটেছে। আনন্দ-উদযাপন আর নানা রকম বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ঈদের দিনে। ঈদ ভালো কাটছে জানালেও মুসকানের মনের গোপনে এক বিষাদ লুকিয়ে আছে। ঈদের পরদিন থেকে তিন দিনের ছুটি মিলছে ওই শিশু পরিবারের বাসিন্দাদের। অনেকেই মা বা অভিভাবকের সঙ্গে চলে যাবে। থেকে যাবে মুসকান।

সবাই চলে যাওয়ার পর এখানে থাকতে কেমন লাগবে? এ প্রশ্নের পর মুসকানের চাহনি দেখে মনে হলো, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’। তবু মুসকান উত্তর দিল, ‘বাড়ি যাইতে ইচ্ছা হইলেও কিছু করার তো নাই।’

মুসকানের মতো আরও ১৬-১৭ জন থেকে যাবে ওই শিশু পরিবারে। তাদের আদতে যাওয়ার জায়গা নেই। তাদের একজন রাবেয়া খাতুন। একই স্কুলে মুসকানের সহপাঠী। নাচ, গান, আবৃত্তিতে পারদর্শী চটপটে স্বভাবের রাবেয়ার ঝটপট উত্তর, ‘বাড়ি নেই, তাই বলে মন খারাপ করে থাকলে তো চলে না। এখানকার ম্যামরা আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবেন। আমরা যাতে কষ্ট না পাই, তার সবকিছু তাঁরাই দেখেন। তাঁরাই তো আমাদের মা–বাবা। মাঝেমধ্যে একটু কষ্ট হয়। তা তাঁদের সঙ্গেই শেয়ার করি। কথা বলতে বলতে মন ভালো হয়ে যায়।’

পুরোনো দিনের জমিদারবাড়ি ‘তাম্বি হাউস’ এখন সরকারি শিশু পরিবারের আবাসস্থল
ছবি: প্রথম আলো

এত সব না পাওয়ার মধ্যেও ঈদের দিন সকাল থেকেই আনন্দ আয়োজনে মেতে উঠেছিল শিশু পরিবারের শিশুরা। একসঙ্গে তারা গেয়ে উঠল, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। সবার পরনে নতুন পোশাক। কেউ কেউ সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কেউ বা একজন আরেকজনকে সাজিয়ে দিচ্ছে। কেউ ব্যস্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া মুঠোফোনে সেলফি তোলায়। একটু ছোটরা সেজেগুজে মঞ্চের সামনে চেয়ারে নিজেদের মতো করে গল্পে মশগুল।

নতুন পোশাক পরে মঞ্চের সামনের দিকের এক কোনায় বসে ছিল ফারিয়া। সে ভিক্টোরিয়া ইনফ্যান্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। কেমন লাগছে? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এল, নতুন জামা, প্রসাধনী, জুতা—সব পেয়েছে সে। এখন নাচ-গান হচ্ছে। ছুটি হলে সে তার মায়ের সঙ্গে সাতক্ষীরায় বাড়িতে যাবে। খুলনার তেরখাদার সুমাও ঈদের পরদিন বাড়িতে যাবে। তবে বাড়ির চেয়ে এখানে বেশি ভালো লাগে বলে জানাল সুমা।

শিশুদের নাচ-গান আর আড্ডার একফাঁকে খুলনা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক খান মোতাহার হোসেন জানালেন তাম্বি হাউসের ইতিহাস। তিনি বলেন, এখন যেখানে খুলনা শিশু পরিবার, সেখানে জমিদার মহেন্দ্র ঘোষের বাড়ি ছিল। একসময় তাঁর ছোট ভাই রাজেন্দ্র নাথ ঘোষ এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। পরে কলকাতায় বসে আমেনা নামের এক নারীকে এই জমি তাঁরা দান করেন। পরে আমেনার মেয়ে তাম্বি ও ছেলে ইব্রাহিম এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁরা ভারত চলে যান এবং সেখান থেকে পাকিস্তানে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭২ সালে আমেনার ছেলে বাংলাদেশ এসে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কাছে ১৪ লাখ টাকায় এই জমি বিক্রি করেন। তখন থেকে বাড়িটি তাম্বি হাউস নামেই পরিচিত।

শিশু পরিবারের কার্যক্রম সম্পর্কে খান মোতাহার হোসেন বলেন, সারা দেশে ছেলে ও মেয়েশিশুদের জন্য ৮৫টি শিশু পরিবার আছে। এখানে পিতৃহীন এতিম শিশুদের ভরণপোষণ থেকে লালন-পালন সবকিছু করা হয়। মোট কথা, এখানে শিশুর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সব রকম বিকাশের জন্য কার্যক্রম রয়েছে। সাধারণত ১৮ বছর পর্যন্ত মেয়েদের এখানে রাখা হয়। মাসের ২ ও ১৫ তারিখে নারী অভিভাবকেরা শিশুদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

দুপুরের দিকে কথা শেষে বের হওয়ার সময়ও চলছিল ওই সাংস্কৃতিক আয়োজন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিশুরা গাইছিল, ‘কিছু স্বপ্নে দেখা, কিছু গল্পে শোনা, ছিল কল্পনা-জাল এই প্রাণে বোনা…।’