সোনারগাঁয়ের নয়াবাড়িতে মহাসড়কে উল্টো পথে যান চলাচল, একের পর এক প্রাণহানি
গত মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার দুপুরে দুই দফায় নয়াবাড়ি এলাকা ঘুরে মহাসড়কটিতে উল্টো পথে যান চলাচল ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত পথচারীদের পারাপার হতে দেখা গেছে।
একজনের আয়ে সাত সদস্যের সংসার চলে না। তাই অভাব ঘোচাতে নিজের তরুণ ছেলেকেও কাজে নিয়ে এসেছিলেন নিরাপত্তারক্ষী হারেস আলী (৪৩)। কিন্তু সংসারের অভাব ঘোচানোর আগেই গত ২৮ আগস্ট সড়ক পার হওয়ার সময় গাড়িচাপায় নিহত হন হারেস। হারেসের মৃত্যুতে পুরো পরিবারের ভার এখন তাঁর ১৮ বছর বয়সী ছেলে আল মামুনের কাঁধে।
হারেস আলী কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ নয়াবাড়ি এলাকার রহিম স্টিল মিলসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশের এ কারখানার সামনেই বাসচাপায় তিনি নিহত হন।
আল মামুনের দাবি, সড়কটির ওই অংশে উল্টো পথে আসা ইজিবাইকের কারণেই তাঁর বাবা বাসের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুতে দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
গত বুধবার দুপুরে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামুন। তিনি বলেন, ‘বাবা সতর্ক মানুষ ছিলেন। সেদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ উল্টো পথে দুটি অটো আসে। বাবা সেগুলো থেকে বাঁচতে দৌড়ে মাঝরাস্তায় চলে যান। তখনই দোয়েল পরিবহনের একটি বাস বাবাকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই বাবা মারা যান।’
আল মামুন বলেন, কেবল তাঁর বাবা নন, নয়াবাড়ি এলাকায় প্রায়ই উল্টো পথে আসা যানবাহনে এমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। তবুও এ সড়কে উল্টো পথে যান চলাচল থামছে না, একটি পদচারী–সেতু হচ্ছে না। এ এলাকায় দুর্ঘটনারোধে প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার দুপুরে দুই দফায় নয়াবাড়ি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে মহাসড়কটিতে উল্টো পথে যান চলাচল ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত পথচারীদের পারাপার হতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুই লেনের এ মহাসড়কের চট্টগ্রামগামী লেনের পাশে ৫০০ মিটারের মধ্যে অন্তত ১২টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং সড়কের উভয় পাশে ২টি উচ্চবিদ্যালয়, ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫টি মাদ্রাসা ও ২টি কিন্ডারগার্টেন অবস্থিত। ব্যস্ততম মহাসড়কটির উভয় পাশেই হরদম উল্টো পথে ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা, এমনকি বাস চলাচল করছে। উল্টো পথে বেশি যান চলাচল করছে নয়াবাড়ি গ্রিন লাইন পরিবহনের ডিপো থেকে কাঁচপুর হাইওয়ে থানা পর্যন্ত। এ সময় এসব যান চলাচল বন্ধে হাইওয়ে পুলিশের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
সেখানে কথা হয় সড়কের পাশের একটি পেট্রলপাম্পের হিসাবরক্ষক জাহিদ হাসানের সঙ্গে। জাহিদ অন্তত ১০ বছর ধরে সেখানে কর্মরত। জাহিদ বলেন, মহাসড়কের নয়াবাড়ি এলাকা একটি মৃত্যুফাঁদ। প্রতি সপ্তাহেই এখানে ছোট–বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এর প্রধান কারণ উল্টো পথে যান চলাচল ও পথচারী পারাপারে পদচারী–সেতু না থাকা।
জাহিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেখানে থাকা বিক্রয়কর্মী রিয়াদ তাঁর মুঠোফোনে থাকা বিভিন্ন দুর্ঘটনার ছবি দেখান। রিয়াদ বলেন, মঙ্গলবার সকাল ও বুধবার বিকেলেও দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুটিই উল্টো পথে আসা ইজিবাইকের ধাক্কায়।
জাহিদ ও রিয়াদ বলেন, নয়াবাড়ি এলাকায় একটি পদচারী–সেতু নির্মাণের জন্য বছর দু–এক আগে তাঁরা এলাকাবাসী মিলে আবেদন করেছিলেন; কিন্তু সেতু হয়নি। ফলে মৃত্যুর মিছিলও থামেনি।
এরই মধ্যে সোমবার নয়াবাড়ি এলাকায় সড়কের ওপর উল্টো পথে আসা ইজিবাইকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন ইসলামী ব্যাংকের গাড়িচালক মো. আমিরুল ইসলাম। আহত আমিরুল চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় সোমবার কাঁচপুর হাইওয়ে থানায় একটি মামলা হলেও সড়কটিতে উল্টো পথে যান চলাচল বন্ধ হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও তিনটি কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কারখানায় অন্তত ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মরত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অন্তত ২০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। কাজ ও পড়াশোনার জন্য প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ আশপাশের এলাকা থেকে নয়াবাড়ি এলাকায় আসেন। তাঁদের অনেকেই সড়ক পারাপার হন।
মঙ্গলবার রাতে মো. ইসলাম মিয়া নামের এক ইজিবাইকচালক প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটিতে প্রচুর শ্রমিক চলাচল করেন। আশপাশের এলাকার শ্রমিক পরিবহনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাঁদের উল্টো পথে যাতায়াত করতে হয়।
এ বিষয়ে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচপুর থেকে মেঘনা পর্যন্ত বিভিন্ন সড়কের অলিগলি থেকে হঠাৎ ইজিবাইক ও রিকশাগুলো প্রধান সড়কে চলে আসে। চেষ্টা করেও সব সময় উল্টো পথে যান চলাচল আটকাতে পারি না। নয়াবাড়ি এলাকাটি শ্রমিক–অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে দুর্ঘটনা বেশি হয়। এখানে একটি পদচারী–সেতু খুবই জরুরি। আমরা উল্টো পথে যান চলাচল বন্ধে আরও সক্রিয় হচ্ছি।’