‘আজও বেড়িবাঁধের ঢালে আশ্রয় নিয়ে পড়ে আছি’

ঘূর্ণিঝড় আইলায় ভিটেমাটি হারিয়ে নদীর বেড়িবাঁধের ঢালে বাস করছে গৃহহারা পরিবারগুলো। বৃহস্পতিবার খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধেছবি: প্রথম আলো

১৫ বছর পার হয়েছে। কিন্তু সেই দিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি উপকূলবর্তী মানুষেরা। এখনো তাঁদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ধ্বংসস্তূপ ও দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। ঝড়ে স্বজন হারানো মানুষের কান্না যেন আজও শোনা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ওই ঘটনা মনে করে আঁতকে ওঠেন। আজ ২৫ মে। ২০০৯ সালের এদিনেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ।

ঘূর্ণিঝড় আইলার দুঃসহ স্মৃতি মনে করে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মঠবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা জিয়া গাইন বলেন, ‘সেদিন সকাল থেকে আকাশে কালো মেঘ ছিল, গুমোট আবহাওয়ায় একটি গাছের পাতাও নড়ছিল না। দুপুর থেকে শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু পানির ঢেউ এসে লন্ডভন্ড করে দিল সব। সেই পানির মধ্য থেকে কীভাবে যে বেঁচে গেছি, তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।’

জিয়া গাইনের স্ত্রী শামীমা বেগম বলেন, ‘আমরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে এক কাপড়ে কোনোরকমে সাঁতরে উঁচু বেড়িবাঁধে এসে উঠেছিলাম। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়, খোলা আকাশের নিচে গ্রামের শতাধিক মানুষের সঙ্গে আমরাও নির্ঘুম রাত পার করি। পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই দেখি আমাদের দেড় বিঘা ভিটেবাড়ির কোনো চিহ্ন নেই। বাড়ির জায়গায় বড় খাল উঠে গেছে। খালের পানিতে মানুষের লাশ ভেসে যেতেও দেখেছি।’

আইলায় বেড়িবাঁধের ২৭টি স্থান জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়; কয়রা উপজেলার বেশির ভাগ অংশ লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। এই দুর্যোগে শুধু এই উপজেলাতেই ৪৩ জনের মৃত্যু হয়।

গত বৃহস্পতিবার কয়রার মঠবাড়ি গ্রামের শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে কথা হয় জিয়া গাইন ও শামীমা বেগম দম্পতির সঙ্গে। হাতের ইশারায় কিছুটা দূরে একটি খাল দেখিয়ে জিয়া গাইন বলেন, ‘আইলার দিন শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ ভেঙে জোয়ার-ভাটার প্রবল স্রোতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২৫০ মিটার চওড়া খালটি সৃষ্টি হয়। ১৫ বছর পরও আমাদের বাড়ির জায়গার ওপর দিয়ে খালের পানি বয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আজও বেড়িবাঁধের ঢালে আশ্রয় নিয়ে পড়ে আছি।’

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা কয়রা উপজেলা জলোচ্ছ্বাসে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেদিন পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি স্থান জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়; উপজেলার বেশির ভাগ অংশ লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। এই দুর্যোগে শুধু কয়রা উপজেলাতেই ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। পরের বছর উপজেলার অধিকাংশ এলাকার বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়। তবে উপজেলার মহারাজপুর, কয়রা সদর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে তিন বছর লোনাপানির নিচে ছিল। তখন ওই সব এলাকায় গাছপালা মরে যায়। পরে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনোরকমে মেরামত করা হলেও শক্ত বাঁধ তৈরি হয়নি। ফলে এখনো অনেক জায়গা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আইলার জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। সেখানে এখন নদীর পানির জোয়ার-ভাটা চলে। বৃহস্পতিবার খুলনার কয়রা উপজেলার পবনা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন ঘেঁষা মঠবাড়ি গ্রামের বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় ইসমাঈল গাজী, ইউনুস আলী, ইলিয়াস গাজী, মজিবর রহমান, রণজিৎ মণ্ডলসহ অনেক মানুষের সঙ্গে। তাঁরা ঘূর্ণিঝড় আইলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে এখনো বেড়িবাঁধের ঢালে বাস করছেন।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আইলার ক্ষত এখনো দৃশ্যমান। কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হারেজখালী, মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা এলাকায় আইলার আঘাতে লোকালয়ে জলোচ্ছ্বাস আসে। তখন স্রোতের তোড়ে তৈরি হওয়া খালগুলোতে এখনো পানি রয়েছে। লোনাপানির কারণে অনেক এলাকায় ফসল ফলে না। নেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, যাতায়াতের রাস্তা, সুপেয় পানি, মানসম্মত স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও। এসব সংকট আর অস্থায়ী বাঁধ ভাঙার আতঙ্ক, উপকূলের বাসিন্দাদের জীবন দিন দিন দুর্বিষহ করে তুলছে।

নদীতে মাছ নেই। মাঠেঘাটে কাজ নেই। চলবে কীভাবে? খাওয়ার পানিটাও আনতে হয় অনেক দূর থেকে। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে টিকে আছি।
সফুরা বেগম, স্থানীয় বাসিন্দা

উপজেলার পাথরখালী এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন আইলায় গৃহহারা ২২টি পরিবার। কয়রা সদরের সোনাপাড়া এলাকায় ৫০টি পরিবার বাঁধের ওপরেই থাকছে। সুতিয়াবাজার এলাকা থেকে মঠবাড়িয়া বেড়িবাঁধের ওপর বাস্তুহারা মানুষের সারি সারি বসবাস চোখ এড়ায় না। ৪ নম্বর কয়রা, ৬ নম্বর কয়রা, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহেশ্বরীপুরসহ কয়রার ৭টি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটা উপজেলায় এখনো বাঁধের ওপর বসবাস করছে দুর্যোগে গৃহহীন ৭ শতাধিক পরিবার।

৪ নম্বর কয়রা এলাকায় গিয়ে দেখা হয় সফুরা বেগমের সঙ্গে। শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘নদীতে মাছ নেই। মাঠেঘাটে কাজ নেই। চলবে কীভাবে? খাওয়ার পানিটাও আনতে হয় অনেক দূর থেকে। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে টিকে আছি।’

ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে উপকূলীয় জনপদে সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে। পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করছেন নারীরা। বৃহস্পতিবার কয়রা উপজেলার ৫ নম্বর কয়রা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, আইলার পর ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস উপকূলে আঘাত হেনেছে। একের পর এক দুর্যোগে সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। অনেকের পেশা বদলে গেছে। মিঠাপানির পুকুরে এখন লোনাপানি। কৃষিজমিতে উৎপাদন কমে গেছে। এখনো বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এ জন্য প্রতিবছর সামান্য ঝড়েই বাঁধ ভেঙে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের মানুষের এখন একটাই দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক উজ জামান বলেন, আইলার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন শেষ না হতেই বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে তাঁরা আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। সরকার কয়রা উপজেলার দুটি ইউনিয়নে মজবুত বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সব ইউনিয়নে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। তখন মানুষের আতঙ্ক কমে আসবে।