কাজ হয়েছে ৮৫ শতাংশ, ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়া যাবে সেপ্টেম্বরে

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়া যাবে। চকরিয়ার শিলখালী অংশ
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আগামী সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা এমনটা জানিয়েছেন। তখন কম খরচে বিলাসবহুল ট্রেনে করে পর্যটকেরা কক্সবাজার ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।

রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই রেললাইন আছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ চলছে। ১৫ মে পর্যন্ত এই রেলপথের ৮৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। আর ছয় তলাবিশিষ্ট রেলস্টেশনের কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। অবশিষ্ট ১৫ শতাংশের কাজ শেষ করে আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেল যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হবে।

কক্সবাজারের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই রেলপথের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন (৬২) বলেন, এই রেলপথের জন্য কত আন্দোলন-সংগ্রাম হলো! অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। রেলপথ এখন কক্সবাজারবাসীর কাছে স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।

প্রতিদিন শত শত মানুষ নির্মাণাধীন রেলপথ ও আধুনিক রেলস্টেশন দেখতে আসেন। এমন একজন দর্শনার্থী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া উম্মে সাদিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম ট্রেনেই তিনি কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যেতে চান।

ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু হলে কক্সবাজারে পর্যটনের নতুন দিগন্তের সূচনা হবে জানিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হবে।

সবার নজর আইকনিক রেলস্টেশনে

কলাতলী সমুদ্রসৈকত থেকে পূর্ব দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া। সেখানে ২৯ একর জায়গাতে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুট আয়তনের এই রেলস্টেশন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে অনেক আগে।

কক্সবাজারের ঝিলংজায় ২৯ একর জায়গাতে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনের চারদিকে গ্লাস লাগানোর কাজ শেষ। ছাদের ওপর চীন থেকে আনা স্টিলের ক্যানোফি বসানোর কাজ চলছে। ভবনের ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন, ফায়ার ফাইটিং, স্যানেটারি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিসহ নানা কাজও শেষের পথে। ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হয়েছে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী-সেতু। এর সঙ্গে যুক্ত হবে পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য ৬৫০ মিটার ও প্রস্থ ১২ মিটার।

রেলস্টেশন দেখতে আসা উখিয়ার ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী (৫৫) বলেন, ‘কক্সবাজারে রেল আসছে, এ কথা স্বপ্নের মতোই লাগছে।’

প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূল ভবনের নিচতলায় থাকবে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনাকক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, পেসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী-সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় থাকবে শপিং মল, শিশু যত্নকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল; চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।

মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হবে ঝিনুকাকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে পদচারী-সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন শহরে। এ জন্য তৈরি হচ্ছে গমন ও বহির্গমনের পৃথক দুটি সড়ক। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের তিনটি বড় জায়গা।

১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার প্রকল্প

রেলওয়ের প্রকল্প-সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। তবে রামু থেকে ঘুমঘুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের কাজ বন্ধ আছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে
ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।